মন্ত্রণালয় থেকে মাঠে, বিতর্ক থেকে বদলি—অদম্য সারওয়ারের গল্প
- আসিফ নজরুল
- প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮ PM , আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:০৭ PM
চলে যাওয়ার দিন ঘটনাটা বললেন মো. সারওয়ার আলম। র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অভিযান চালিয়ে দেশজুড়ে একসময় প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল দুর্নীতিবাজ চক্র। তার প্রমোশন আটকে দেওয়া হয়, গুরুত্বহীন পদে বদলি করা হয় প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে। মনমরা হয়ে সারওয়ার বসে থাকতেন ধূসর আলোর কক্ষে।
কোভিডের শেষদিক তখন। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য ভ্যাকসিন পেতে মরিয়া হয়ে কর্মীরা ঘেরাও করে মন্ত্রণালয়। তাদের নানা রকম আশ্বাস দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সচিবও বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা, কারও কথা বিশ্বাস করেন না। শোরগোল ছাপিয়ে একটি কথা ভেসে এল—শুধু একজন বললে তার কথা বিশ্বাস করবেন প্রবাসগামী কর্মীরা। তিনি সারওয়ার!
অবশেষে সারওয়ারকে নিচে আসতে বলা হলো। তাকে দেখে কর্মীরা শান্ত হলো। সারওয়ার আশ্বাস দিলেন কবে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তার আশ্বাস যেন জাদুর মতো কাজ করল। কর্মীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে চলে গেল। মন্ত্রী-সচিব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সারওয়ার নিজ কক্ষে ফিরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন। এই ঘটনা বলার সময় চোখ মুছলেন তিনি। আমরাও তাই করলাম।
২
সারওয়ারকে আমি প্রথম দেখি আলোচনার টেবিলে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব মাত্র নিয়েছি তখন। কনফারেন্স রুমে বিশাল লম্বা টেবিলে বসে উত্তেজিতভাবে কী কী করতে হবে তা বলছিলাম। কারও মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছিল না। শুধু মাঝারি গড়নের, আমার মতোই সাদামাটা একজন সারাক্ষণ উৎসাহ নিয়ে কথা বলছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, তিনি হবেন আমার পিএস। অল্পদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম—এই সাদাসিধে মানুষটিই একসময়ের বিখ্যাত সারওয়ার।
তাকে তবু আমি খুব বেশি স্নেহ করতে পারিনি, বরং বকাবকিই করেছি বেশি। কাজ এগোয় না এই হতাশা সবসময় থাকত। তার ওপর যাকেই কিছু জিজ্ঞেস করি, দেখি সারওয়ারই আগ বাড়িয়ে সব বলে দেন। আর ছিল আমার জন্য তার বাড়াবাড়ি রকম যত্ন। এয়ারপোর্টে যাওয়া বা ফেরা—কতবার বলেছি, “আপনাকে যেতে হবে না।” কিন্তু যাবেনই তিনি। বকাবকি বেশি হয়ে গেলে নিজেই মন খারাপ করতাম, এক-দু’বার হয়তো তাকে সরিও বলেছিলাম।
সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত কাজ করেন যান্ত্রিকভাবে। বাড়তি দায়িত্ব বা সংস্কার নিয়ে খুব একটা আগ্রহ থাকেন না। তবু প্রধাণত সারওয়ারের (এবং আরও কয়েকজনের) সার্বক্ষণিক সহায়তা আর সমর্থন নিয়েই কয়েকটি বড় কাজ আমরা করতে পেরেছিলাম। যেমন—প্রবাসী কর্মীদের ছাড়পত্র সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করা, মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপল ভিসা কার্যকর করা, জাপান ও কোরিয়ার বাজার আরও কিছুটা উন্মুক্ত করা, প্রবাসী লাউঞ্জ স্থাপনসহ প্রবাসী কল্যাণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া।
লক্ষ্য যতটা ছিল তার অর্ধেকই কেবল করা গেছে। এর মধ্যেই এলো সারওয়ারের বদলির খবর। সিলেটে সাদাপাথর বিতর্কের পর তড়িঘড়ি করে তাকে সেখানে ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। অবাক হয়ে দেখলাম, আমার সিলেটি বন্ধু ও পরিচিত মহলে আনন্দের বন্যা বইছে। আমি তাকে আটকাব কোন বিবেচনায়!
৩
তাকে নিয়ে একটা দুঃখ রয়ে গেল। আমার সম্পর্কে ফেসবুক আর ইউটিউবে নানান আজগুবি খবর আসে। এগুলো অস্বাভাবিক নয়। আমার বিরুদ্ধে আছে ফ্যাসিস্টরা, আছে উগ্রবাদীরা, আছে ভিউ ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আমাদের সারওয়ার…! রাজনীতির ধারেকাছে না থাকা, আপাদমস্তক পেশাদার মানুষ তিনি। তবু তার বিরুদ্ধেও কালিমা লেপনের চেষ্টা হয়েছে। এর প্রতিকার পুরোপুরি করতে পারিনি—এই কষ্ট থাকবে।
সারওয়ার, আপনাকে মিস করি। দোয়া করি, জুনিয়র অফিসাররা আপনাকে দেখে শিখুক। শুধু সিলেট নয়—সততা, সাহস আর কর্মনিষ্ঠার জন্য সারাদেশের মানুষ ভালোবাসে আপনাকে। আমাদের আশাবাদী থাকার এটাও একটা কারণ।
আসিফ নজরুল: কথাসাহিত্যিক ও উপদেষ্টা, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়