জিয়াউর রহমান কেন অনন্য: রাষ্ট্রনীতি ও আদর্শ

মো. ছানাউল্লাহ 
মো. ছানাউল্লাহ   © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান বীরোত্তম জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আমরা নতুন প্রজন্ম খুব কম জানি। কম জানি কারণ তাকে নিয়ে জানতে দেওয়া হয়নি। বিগত সময়ে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অনবরত স্মিয়ার ক্যাম্পেইন ছিল। এখনও যদি জিয়া লিখে গুগলে সার্চ করা হয় বেশিরভাগ রেজাল্ট আসবে শেখ মুজিবকে হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে জিয়াকে জড়িত করে অথবা জিয়াউর রহমানকে হত্যা নিয়ে মুখরোচক গল্প নিয়ে।

কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পররাষ্ট্রগত দিক থেকে জিয়াউর রহমান এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেখ মুজিবের শাসনামলের নেতিবাচক ও নৈরাজ্য থেকে বের হয়ে একটি প্রকৃত স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হোন। আদর্শগতভাবে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পথচলার গতি নির্ধারণ করে দেন। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মি যখন ঢাকায় নিরীহ বাঙালির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন পুরো দেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। শেখ মুজিব অ্যারেস্ট হন নিজ বাসায়। এই পরিস্থিতিতে একজন সামরিক কর্মকর্তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে বাঙালিরা স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আশান্বিত হয়। তরুণ ও যুবকদের এক বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্ক আছে তাতে এটা স্পষ্ট যে অন্যান্য কেউ কেউ এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন হয়ত কিন্তু জনগণের নিকটে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটিই পৌঁছেছিল। জিয়াউর রহমান নিজেকে Provisional Head of Bangladesh এবং Liberation Army Chief হিসেবে ঘোষণা দেন। জিয়াউর রহমানের এই ডাক শুনে অসংখ্য ছাত্র-তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। রেডিও থেকে ভরাট কণ্ঠের “আমি মেজর জিয়া বলছি” আহ্বান উদ্দীপিত করেছিল কোটি বাঙালিকে। 

কিন্তু ইতিহাসের এই অধ্যায়টি যেভাবে এগিয়েছে সেটা কাম্য ছিল না। ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার রাজনীতিক ও ঐতিহাসিকরা এটাকে কোর্টে নিয়ে গেছেন। আমাদের দেশে রাজনীতি যেমন “জুডিশিয়ালাইজেশন” করা হয়েছে তেমনি ইতিহাসকেও “জুডিশিয়ালাইজেশন” করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে প্রকৃত ইতিহাস পালটায় নি বরং স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। 

জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলনীতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বদলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে ন্যায়বিচার স্থাপন করেছিলেন। এবং জাতীয়তাবাদ হিসেবে বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেছিলেন। সংবিধানের এই মূলনীতি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের দূরদর্শিতার দিকে ইঙ্গিত করে। শেখ মুজিবের শাসনামলে ১৯৭২ সালে যেই সংবিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে ধর্মকে রাষ্ট্রের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীর কাতারে নিয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের বদলে ধর্মযুদ্ধ পছন্দ করতেন। 

উদাহরণস্বরূপ জামায়াতের রাজাকার-আলবদরদের প্রশ্নে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দিয়ে দেশীয় দালালদের বিচার শুরু করেও শেষ না করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সদিচ্ছা থাকলে নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, জামায়াত বা ছাত্র সংঘের বিচার না করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেন। যা তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব প্রমণ করে। ঐতিহাসিক এই দায় যথাসময়ে সমাধান করা এলে পরবর্তীতে দেশের রাজনীতি এত বিভেদ সৃষ্টি হত না। জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরির দেখানো পথে হাঁটেন নি। তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানের এই পরিবর্তনগুলো করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি হয়ত অবচেতনভাবেই বাংলাদেশি মুসলিম জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছেন।

জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র মেরামতের এই দর্শন বাংলাদেশকে দীর্ঘকালীন স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে যারা একটি স্বাধীন দেশে সম্মানের সাথে নাগরিকত্বের পরিচয় ধারণ করতে চান। সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেভাবে ডিল করা হয়েছে তাতে বাঙালি ব্যতীত অন্যদের পরিচয়কে অনাবশ্যক করে ফেলা হয়েছিল। এছাড়া প্রতিবেশী দেশের পশ্চিমবঙ্গে যে-সব বাঙালিরা ছিলেন তাদের সাথে বাংলাদেশের বাঙালিদের ঐতিহাসিক সংমিশ্রণকে অস্বীকার করে একটি চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি চালুর চেষ্টা ছিল। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মানুষকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংবিধানের মূলনীতিতে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” স্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয়তা ইস্যুর ঐতিহাসিক বিতর্ককে ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান দেন। 

১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব যখন সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ঘোষণা করেন তখন আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের অন্যতম মূল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রাচার সংক্রান্ত পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন। গণতন্ত্রের পুনঃপবর্তনের এই সময়ে নিজেও তাঁর রাজনৈতিক সংস্কারকে টেকসই করতে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন যেই দলটি একটি উদার গণতান্ত্রিক মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশপন্থার রাজনীতি করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমান ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশের শাসনে অন্য কোনো দেশ বা আদর্শের বদলে বাংলাদেশ পন্থাকে গ্রহণ করেছিলেন। 

দিল্লির আধিপত্যবাদী চেতনা বাস্তবায়নে আমরা বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো জিয়াউর রহমানকে নানা অভিধায় ভূষিত করলেও প্রকৃত বাংলাদেশপন্থার রাজনীতি যে জিয়াউর রহমান থেকেই এসেছে সে বিষয়ে মতানৈক্য করার সুযোগ নেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলটি সময়ের প্রেক্ষিতে নানান রাজনৈতিক কৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ করলেও জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও নীতির পথে দৃঢ় থাকলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার জন্য কল্যাণজনক হবে।

লেখক: শিক্ষক, গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ