পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে বিশ্ব বই দিবসের গুরুত্ব

এম এ মতিন
এম এ মতিন  © টিডিসি সম্পাদিত

ভূমিকা: আজ ২৩ এপ্রিল। ‘বিশ্ব বই দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে – ‘রিড এন্ড এডভেঞ্চেয়ার’ অর্থাৎ ‘পড়ুন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করুন’। ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। ‘বিশ্ব বই দিবস’র মূল উদ্দেশ্য হলো—বই পড়া, বই প্রকাশ, বই এর ব্যবহার বৃদ্ধি, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা, ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। ‘বিশ্ব বই দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. উড্রে আজুল্যে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাণী প্রদান করেছেন

বিশ্ব বই দিবসের পটভূমি: ১৯৯৫ সালে প্রথমবার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালিত হলেও ২০০১ সালে, বই বিক্রেতা, প্রকাশক এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার সমিতির অনুরোধে ‘বই দিবস’-এর সঙ্গে ‘গ্রস্থস্বত্ব’ শব্দটি জুড়ে দেয় ইউনেস্কো। সেইসঙ্গে ঠিক হয় প্রতিবছর বিশ্বের ‘বই রাজধানী’ হিসাবে বেছে নেওয়া হবে একটি করে শহরকে। ২০২৫ সালের জন্যে ‘গ্রন্থ রাজধানী” হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে ব্রাজিল’র রাজধানী রিউ-ডি জেনেরিউ কে। ২০২৪ সালে ‘বই রাজধানী’ ছিল আফ্রিকা মহাদেশের দেশ ঘানা’র রাজধানী ‘আক্রা’।

১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব বই দিবস’র যাত্রা শুরু হলেও মূল ধারণাটি আসে প্রায় ৪০০ আগে ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। ঐ দিন মারা যান স্পেনের বিখ্যাত কবি ও লেখক মিগেল দে সার্ভান্তেস। ভিন্সেন্ট ক্লাভেল আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাবশিষ্য। আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের হাতেখড়ি হয় তার সার্ভান্তেসের হাত ধরেই। কিংবদন্তি এই কবির মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল দিনটিকে ‘গ্রন্থ দিবস’ হিসাবে উদযাপন করেন তাঁরই ভাবশিষ্য জনপ্রিয় স্প্যানিশ কথাসাহিত্যিক ভিসেন্ট ক্লাভেল আন্দ্রেস। শুধু সার্ভান্তেজ নয়, ২৩ এপ্রিল কিংবদন্তি ইংরেজ  নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারেরও মৃত্যুদিন। পাশাপাশি এপ্রিলের ২৩ তারিখেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলম্বিয়ান লেখক  ম্যানুয়েল মেইয়া এবং স্প্যানিশ পেরুভিয়ান লেখক ইনকা গার্সিলাসু ডেলা ভেগাসহ একাধিক খ্যাতনামা সাহিত্যিক। ঘটনাচক্রে আজকের তারিখেই প্রয়াত হয়েছিলেন  ভারতের সুখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো স্পেনের এক প্রস্তাব অনুযায়ী ২৩ এপ্রিলকে’ বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বিশ্ব বই দিবস পালনের গুরুত্ব: দেশের সকল স্তরের মানুষকে বিশেষ করে ছাত্র,  শিক্ষক ও গবেষকদের অধিকতর গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা, জাতিগঠনে গ্রন্থাগারের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা,  দেশে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলোতে  জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর সর্বশেষ প্রকাশিত  বই ও সাময়িকীর তথ্যাদি সংগ্রহ, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময়, মননশীল সমাজ গঠনে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, পাঠসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং পাঠক তৈরির মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং গ্রন্থাগারকর্মী ও পেশাজীবী, লেখক, প্রকাশক, পাঠক বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে  ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা মনে করি, একই উদ্দেশে  (ইউনেস্কো কর্তৃক নিরূপিত) সামনে রেখে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সরকার ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা আরও মনে করি, ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ এবং ‘বিশ্ব বই দিবস’ যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে জাতিকে বইমুখী করার বিকল্প নেই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যাহারের পাশাপাশি মুদ্রিত বই পাঠেও ছাত্র শিক্ষক গবেষকসহ সকল শ্রেণির নাগরিককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখানেই।

সংশ্লিষ্ট সবাই বিশ্বাস করেন যে, ‘বিশ্ব বই দিবস’ পালনের মাধ্যমে সকল স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বই পড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবন মানের উন্নতি ঘটাবেন। বলা দরকার যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের এজেন্ডা মাথায় রেখে আমরা যদি অগ্রসর হতে চাই তাহলে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির আর কোন বিকল্প নেই। 

এ  অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ ‘একত্রিংশতিতম ‘বিশ্ব বই দিবসে’  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের গ্রন্থাগার ও শিক্ষার মান পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমরা জানি, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। আমরা এও জানি যে, বর্তমান যুগে  কোন জাতির উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা পরিমাপক যন্ত্র হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের পরিমাণ অর্থাৎ যে জাতি যত বেশি পরিমাণে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশি উন্নত। গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের বর্তমান মানদণ্ড হচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, বৈশ্বিক অর্থনীতি সূচক এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশ্বিক র‍্যাংকিং।

বিগত  বছরগুলোতে  দারিদ্র্য দূরীকরণ, উৎপাদনশীলতা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাত, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ফলত ২০১৫ সালে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, প্রয়োজনীয় সকল চলকে [গ্রস ন্যাশনাল ইনডেক্স (জিএনআই), হিউম্যান এসেটস ইনডেক্স (এইচএআই) এবং ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইন্ডেক্স(ইভিয়াই),] ঈপ্সিত ফলাফল অব্যাহত রাখতে পারলে ২০২৬ সাল থেকে (করোনা মহামারির জন্যে এ সময় জাতিসংঘ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করেছে)  উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে স্বীকৃত হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতেই নয় বিশ্বব্যাংক’র ২০২০ সালের প্রতিবেদনে লক্ষ্য করা যায় যে, উল্লিখিত সময়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরি এবং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে।  কিন্তু বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে  অন্যান্য দেশের তুলনায়  বাংলাদেশকে ঈপ্সিত স্থানে পৌঁছাতে গ্রন্থাগার ব্যবহার ও শিক্ষার মানের আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।  গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে বাংলাদেশ  ধারাবাহিকভাবে খারাপ করে চলেছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ।

মোবাইল/স্মার্টফোন ব্যবহারের অপকারিতা: প্রযুক্তির কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক আমাদের সমাজে বই পড়ার অভ্যাসটা কমেছে দারুণভাবে। এখন সবার চোখ বই এর স্থলে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে।  বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক বেড়েছে ২০ লাখ। এর মধ্যে বিরাট অংশ তরুণ । বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৯ বয়সী মানুষ আছে প্রায় ২ কোটি ৬৮ লাখ। এদের অধিকাংশই ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইমো ও লাইকি সহ আরো অনেক ধরনের ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তরুণরা গড়ে দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা সময় এ সকল ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যয় করে।

১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্য যাদের জন্ম, তাদের ‘আইজেন’ বলা যায়। এ প্রজন্ম স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সম্বল করে বেড়ে উঠেছে। তাদের আচরণ ও আবেগের ধরন আগের প্রজন্মের  চেয়ে আলাদা। আইজেনের এ পরিবর্তনে মানসিকভাবে তারা বেশি ঝুঁকিতে। তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা ২০১১ সাল থেকে বাড়তে দেখা গেছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে ‘আইজেন’ সবচেয়ে বেশি মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। তারা শুধু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আলাদা নয়, তাদের সময় কাটানোর ধরনও আগের চেয়ে আলাদা। প্রতিদিন তারা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা ও চমক চায়। একই ছাদের নিচে মা-বাবার সঙ্গে থেকেও মা-বাবার কাছ থেকে আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেকটাই দূরে আইজেনরা। মা-বাবার সঙ্গে এখনকার তরুণেরা কথা বলে কম। তাদের বলতে শোনা যায়, ‘ওকে’, ‘ঠিক আছে’ জাতীয় সংক্ষিপ্ত উত্তর। এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাদের ফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরিবারের সদস্যদের দিকে মন থাকে কম। তারা বিছানায় শুয়ে-বসে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোররা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ‘আইজেন’ প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে।

এছাড়া সম্প্রতি আর এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু-কিশোররা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ধাবিত হচ্ছে অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রভাবিত হয়ে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমকে (কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, বিভিন্ন অ্যাপলিকেশন সফটওয়্যার, বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অ্যাপস, ইত্যাদি) দ্রুত যোগাযোগের অন্যতম বাহন হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে এ সকল ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার।

প্রযুক্তির এমন অপব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও। অনেকটা বাধ্য হয়ে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন অথবা ডিজিটাল ডিভাইস। অভিভাবকরা বলছেন, এই ধরনের প্রযুক্তিগুলোতে তারা এতটাই আসক্ত যে তাদের যদি কোনোকিছু প্রয়োজন হয়, আর সেটিতে বাধা দিলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে। প্রযুক্তির দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে বই পড়ার অভ্যাসটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যে জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেটি পুঁজিবাদী সমাজের একটি অংশ। মূলত মুনাফার জন্য এ নতুন সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। যা তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পারিবারিকভাবে তাদের সামনে উন্নত আদর্শ তুলে ধরা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে তরুণদের মুদ্রিত পাঠসামগ্রীর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে এসব অপরাধ থেকে আইজেন প্রজন্মকে বিরত রাখা সম্ভব।

আজকের পৃথিবীতে স্ক্রিন আসক্তি বা নেট আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে জীবনগ্রাসী মাদকাসক্তির সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে বাঘা বাঘা প্রযুক্তি বিশ্লেষক প্রযুক্তি আসক্তির অশনিসংকেত দিচ্ছেন জোরালোভাবে। প্রযুক্তির কল্যাণকর দিকগুলো অবশ্যই অস্বীকার করা যাবে না। সকাল থেকে বিছানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবেই প্রযুক্তির কল্যাণকর দিকগুলো গ্রহণ করছি। তবে নিজেদের অজান্তেই কিছু অকল্যাণকর দিকেও জড়িয়ে ফেলছি নিজেদের। এখন সময় এসেছে এর অকল্যাণকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়ার।

দারুণ সুকৌশলে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আমাদের তরুণ–তরুণীদের মগজ ধোলাই করে তাদের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিয়ে নিবদ্ধ করছে প্রতিদিনকার পোস্ট, লাইক, শেয়ার আর কমেন্টে। যেন জীবনের গণ্ডি আঙুলের ছাপের কিছু লাইক, শেয়ার আর কমেন্ট সেকশনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো তরুণ সমাজের যেমন উপকার করছে, তেমনি তাদের নিজেদের অজান্তে তাদের ঠেলে দিচ্ছে কিছু অন্ধকার দিকে। সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ সমাজে যেসব ক্ষতি ডেকে আনছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে - সামাজিক নিঃসঙ্গতা, সৃজনশীলতা হ্রাস, সক্রিয়তা হ্রাস, অস্বাভাবিক আচরণ, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া, ইত্যাদি।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি তীব্র টান তরুণ–তরুণীদের বাধ্য করছে একটানা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকতে। অর্থহীন সময় কাটছে। প্রোডাকটিভ কিছুতেই তারা মনোনিবেশ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাদের চিন্তাশক্তি আর কর্মশক্তি চলে যাচ্ছে অন্যের দখলে। তাই একসময় এসে তারা নিজেদের নিষ্ক্রিয় জড়বস্তু হিসেবে খুঁজে পাচ্ছে।

হয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন মাদকাসক্তি নিরাময়ের মতো করে স্ক্রিন বা নেট বা সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির জন্যও নিরাময় সেন্টার খুলতে হবে। খুঁজতে হবে কার্যকর সমাধান। তাই আসুন বেলা ফুরাবার আগেই সচেতন হই, যেন সোশ্যাল মিডিয়া নয়; বরং আমরাই সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজেদের প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করছি। স্ক্রিন আসক্তির বাস্তব যে কুফল তা আমাদের ‘আইজেন’দের লেখাপড়ার বর্তমান অবস্থা ও পরীক্ষার ফলাফল দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। চলতি বছরসহ গত কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা ৯০% অকৃতকার্য হচ্ছে। এই ফলাফল পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের বই এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যেনতেন ভাবে তারা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আসলেও নকল বিহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাদের লেখাপড়ার আসল চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। সুতরাং এই অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। আর এর একমাত্র পথ হচ্ছে – তরুণ-তরুণীদের সামনে মোবাইল স্ক্রিনের বিকল্প মুদ্রিত পাঠসামগ্রী উপস্থাপন।

বই আমরা কেন পড়বো: শরীর সুস্থ রাখার জন্য যেমন স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনিভাবেই ব্রেন তথা মস্তিষ্ককে সুস্থ, কার্যক্ষম ও সচল রাখার জন্য খাদ্য দেওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা জানাচ্ছে, বই পড়ার অভ্যাসটিই হলো মস্তিষ্কের খাদ্য! পুস্তক পাঠ স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। বই পড়া ব্রেনের জন্য ভীষণ উপকারী। 

গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বই পড়ার অভ্যাসের ফলে মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। মানসিকভাবে সবসময় উদ্দীপ্ত থাকার ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কারণ, মস্তিষ্ক সব সময় অ্যাকটিভ থাকার ফলে, তার কর্মক্ষমতা হারানোর সম্ভবনা কমে যায়।

এছাড়া বই পড়া মানসিক চাপ কমায়, স্মৃতিশক্তি প্রখর করে, বৃদ্ধি পায় কল্পনাশক্তি, যৌক্তিক চিন্তায় দক্ষ হওয়া যায়, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, রাতে দ্রুত ঘুমাতে সাহায্য করে, কোন বিষয়ে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়, বৃদ্ধি পায় সৃজনশীলতা

আজকাল মানুষের মধ্যে একটা পরিবর্তন বেশ লক্ষ্য করা যায়। কোন আড্ডা বা মজলিশে বই কিংবা শিল্প সাহিত্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে না। দর্শন, বিজ্ঞান, লেখালেখি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয় না। আড্ডার বিষয়বস্তুতে প্রধান হয়ে উঠে রাজনীতি, প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব আর নিত্য নতুন পোশাক ও জুয়েলারির আলাপ। এছাড়াও বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্য, যশ, প্রাচুর্য আর বিত্তের প্রচার ও প্রকাশে অনেকেই অস্থির! সেই সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় কায়ক্লেশে থাকা জীবনেও এমন সব পোস্ট বা ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেসব খুব বিভ্রান্তিকর। এইসব বিভ্রান্তিমূলক কাণ্ড কমিয়ে তারা যদি একটু বই পড়ায় মনোযোগী হতো তাহলে সমাজটা বোধহয় আরেকটু সভ্য হতো!  

অযাচিত প্রদর্শনীর এই মহামারি নিরাময় করতে পারে বই। অথচ এখন উপহার হিসেবেও মানুষ আর বই আদান-প্রদান করে না। পরস্পর পরস্পরকে বাহারী শাড়ি, জুয়েলারি, ঘর সাজাবার সামগ্রী কিংবা যা কিছুই উপহার দিক না কেন বই অন্তত এই তালিকায় নেই। 

শুদ্ধ চিন্তার বিকাশে বই পড়া একটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ অভ্যাস। বিভিন্ন ইলেক্ট্রোনিক্স ডিভাইস থেকে একটু অন্য দিকে নিজেকে ফেরাতে বই বিশেষ ভূমিকা রাখতে সহায়ক। আমরা আবার যদি সে অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনতে পারি সেটা আমাদের শারীরিক ও মানসিক দু’দিকেই লাভজনক। বই কেনার অভ্যাসে  শোকেসে কিংবা ঘরে রেখে দিলেও কোন এক অবসন্ন সময়ে হয়তো হাতে নিতে ইচ্ছে করবে। অপরের ভাবনাগুলো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। এটি করতে পারে একমাত্র বই ও বই পড়ার বিগত অভ্যাস ফিরিয়ে আনা। ‘বিশ্ব বই দিবস’  থেকেই না হয় শুরু হোক এর মূল্যায়ন!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউসিএলএ সেন্টার ফর ডিসলেক্সিয়ার ডিরেক্টর বলেন, ‘ভাষা শেখা কিংবা কোন কিছু লেখার চাইতেও বই পড়ার সময় একজন পড়ুয়া অনেক বেশি চিন্তাভাবনা করেন। যা তাকে কাল্পনিক জগতে বিস্তৃতভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়, চিন্তার নতুন অনেক দ্বার খুলে দেয়। এতে করে ভাষা শেখার চাইতেও অনেক বেশি উপকৃত হয় মস্তিষ্ক’। আরও দারুণ বিষয় জানাচ্ছে ইমোরি ইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটির এক গবেষণাকর্মের  তথ্য থেকে দেখা গেছে, বই পড়ে শেষ করার পাঁচ দিন পরেও মস্তিষ্কে তার কার্যকারিতা চলতে থাকে।

শারীরিক কোন কাজের কথা পড়ার সময় নিউরন সেরূপভাবে কাজ করা শুরু করে। এক্ষেত্রে দায়ী হলো মোটোর নিউরন ফাংশন। বলা যেতে পারে, বই পড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কের দারুণ ব্যায়ামও হয়ে থাকে।

বই পড়ার ফলে যে ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে, তা তুলনাহীন। বইপড়ুয়া মানুষেরা জানেন, এক একটা বই কতটা ভালোবাসার ও প্রিয় হতে পারে। প্রিয় বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আনন্দ-বেদনার স্মৃতি, ভালো সময় কাটানোর অনুভূতিগুলো যেন পৃথিবীর অন্যান্য সকল অনুভূতির কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ।

শুধু মানসিক নয়, শারীরিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে বই পড়ার অভ্যাস। এমনকি খোলা কোন স্থানে হাঁটা কিংবা পছন্দের কোন গান শোনার চাইতেও, মানসিক চাপ কমাতে বই পড়া বেশি উপকারী।

প্রতিবার নতুন এক একটি বই পড়ার সময়, পাঠককে গল্পের অনেকগুলো চরিত্র, গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড, গল্প ও চরিত্রের ইতিহাস, প্রতিটি চরিত্রের ক্যারেক্টারিস্টিক, গল্পের সাব-প্লট সহ আরও অনেক কিছুই মনে রাখতে হয়। কারণ, বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় গল্প মোড় নিতে থাকে। এই সকল কিছু ভালোভাবে মনে না রাখলে বইটাই তো বোঝা যাবে না। একইসঙ্গে অনেককিছু মনে রাখার অভ্যাসের সঙ্গে স্মৃতিশক্তি প্রখর হতে থাকে।

বইয়ের কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে ও কাল্পনিক ঘটনার ভেতর ডুবে যেতে চাইলে নিজেকেও হারিয়ে ফেলতে হয় সেই কাল্পনিক জগতে। গড়ে নিতে হয় নিজের একটি কাল্পনিক পৃথিবী। কল্পনা করার এই অভ্যাসের ফলে অন্যান্য আর দশজনের চাইতে ভালো কল্পনাশক্তির অধিকারী হওয়া যায়।

বিভিন্ন ধরনের উপন্যাস ও গল্পের নানান ঘটনা ও টার্ন, যেকোনো পরিস্থিতিতে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মতো মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে দেয়। কোন একটি গোয়েন্দা কিংবা রহস্য কাহিনী অথবা থ্রিলার কাহিনী একজন ব্যক্তিতে নানান আঙ্গিক থেকে ভাবার ও চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসের ফলে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার চর্চাটি বজায় থাকে।

ব্যস্ত জীবনের নানা কাজের চাপে একসাথে অনেকগুলো কাজ কিংবা মাল্টিটাস্কিং এর মাঝে থাকতে হয়। এই মাল্টিটাস্কিং এর ফলে কোন একটা কাজের প্রতি ফোকাস করার অভ্যাস কমে যায়। সেইসঙ্গে কমে যায় মনোযোগ ধরে রাখার দক্ষতা।

কিন্তু বই পড়ার সময় অন্য কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। কারণ বই পড়ার সময় একটুও অন্যমনস্ক হলে কাহিনীর ধারাবাহিকতা হারিয়ে যায়। প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট বই পড়ার অভ্যাস কাজের প্রতি ফোকাস ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ার ফলে নার্ভ ও মন শান্ত হয়। ফলে খুব অল্প সময়ের মাঝেই ঘুম চলে আসে। অন্যদিকে টিভি দেখা কিংবা মোবাইল ফোন স্ক্রল করার ফলে নার্ভের উপর প্রেশার পড়ে এবং স্ক্রিনের ব্লু-রে ঘুমকে নষ্ট করে দেয়। ফলে রাতের ঘুমের সাইকেলে ব্যাঘাত ঘটে।

জীবন মানেই নানান ধরনের পরীক্ষা, চ্যালেঞ্জ। সবসময় নিজেকে সকল পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। প্রায়শ ক্লান্তিভাব চলে আসে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে। এমন সময়গুলোতে প্রয়োজন হয় অনুপ্রেরণার। বইয়ের চমৎকার গল্প এক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কাল্পনিক গল্পগাঁথা কিংবা আত্মজীবনীমূলক বই পড়লে নিজের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়, নিজের ভুলগুলো কিংবা নিজের শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এমনকি জীবনের উদ্দেশ্যকেও নির্ধারণ করা সম্ভব হয় অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো বই পড়ে।

নেদারল্যান্ডের এক গবেষণা থেকে গবেষকেরা দেখেছেন, অন্যান্য সকলের চাইতে বইপড়ুয়ারা কাল্পনিক চরিত্র ও গল্পের মাধ্যমে খুব সহজেই ‘ইমোশনালি ট্রান্সপোর্টেড’ অর্থাৎ আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। কোন একটি বই পড়ার সময় বইয়ের গল্প ও চরিত্রের মাঝে নিজেকে খুব সহজেই মিশিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। নিজেকে তখন চরিত্রগুলো আনন্দ-বেদনার অংশ বলে মনে হতে থাকে। তাদের কষ্টে চোখে পানি জমে, হাসি ফোটে তাদের আনন্দে। এর ফলে সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। অন্যের অবস্থা ও অন্যের দুঃখ-কষ্টকে সহজেই অনুধাবন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

অবসর সময়ে সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন অনেকেই। কিন্তু সিনেমার চাইতে হাজারগুণ বিনোদনপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর গল্প থাকে একটি বইয়ে। এমনকি অনেক সিনেমা নির্মিত হয় বইয়ের গল্প অবলম্বনে। তবে বইয়ের গল্পের খুব স্বল্প অংশই উঠে আসে পর্দায়। ফলে একটি বই পড়ে যতটা ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে, অনেক সিনেমাতেই তেমনটা হয় না। এজন্যেই ইউনেস্কো এ বছরে ‘বিশ্ব বই দিবস’র প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে,’রিড এন্ড অ্যাডভেঞ্চার’।

তবু আশাহত হলে চলবে না। আমরা তো জানিই — ‘আশা তার একমাত্র ভেলা’। সেই ভেলায় ভেসে বলতে পারি, কোনো একদিন ঢাকা শহরকেও বই শহর ঘোষণা করবে ইউনেসকো। বই নিয়ে তৎপরতা বাড়বে মানুষের মধ্যে। বই হয়ে উঠবে নিত্যসঙ্গী। 

বই এমন এক মাধ্যম যার সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দেয়’। আবার চাণক্য বলেছেন, ‘বিদ্যা যাহাদের নাই, তাহারা ‘‘সভামধ্যে ন শোভন্তে’’।’ আর কে না জানে, বিদ্যা অর্জন করার এক অনবদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে বই। কাজেই বই দিবস সাড়ম্বরে পালন করা হোক আর না হোক, বইয়ের আবেদন কখনো ফুরাবে বলে মনে হয় না। যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন মানুষের নিঃসঙ্গ প্রহরে বই জ্বেলে দেবে উজ্জ্বল প্রদীপ। কোনো শ্রান্ত দুপুরে, কিংবা বিষণ্ন বিকেলে বই হয়ে উঠবে প্রিয় সঙ্গী। ঘুম ঘুম শীতের রাতে অচিন কুয়াশার মতো জড়িয়ে ধরবে বই। একটি বই অনেক কিছু মনে করিয়ে দেবে আমাদের।   কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই নিয়ে একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেন,  ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়’। যারা বই পড়েন তারা মূলত এখান থেকে আনন্দ পান। আনন্দ লাভের সাথে জ্ঞান লাভ হয়। নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। একটি সুশিক্ষিত ও বই পড়ুয়া জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

বই পড়া জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রসারিত করে। বই পড়ার মাধ্যমেই নতুন শব্দভাণ্ডারে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারা যায় । স্মরণশক্তি বাড়াতে দারুণ এক কার্যকরী ভূমিকা রাখে বই পড়া । বই পড়ার মাধ্যমে যেকোনো একটা বিষয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অথবা দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ভালো বই পাঠ চিন্তার উৎকর্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। বই পড়লে শুদ্ধ করে, সুন্দর শব্দ চয়নে লিখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

মানসিক প্রশান্তি বাড়াতে বই এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারেনা। নির্জনতায়  এবং বিষণ্নতায় নিজের মতো করে শব্দহীন বিনোদন এবং নিজের সুন্দর একটি আবহ তৈরি করতে বই পড়ার বিকল্প নেই । ২৩ শে এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য তারিখ। বহু বিশিষ্ট লেখকও এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং, এই দিনটিতে লেখকদের শ্রদ্ধা জানানো একটি স্বাভাবিক পছন্দ ছিল। এটি এমন একদিন যখন চিত্রকর, লেখক এবং প্রকাশকরা একত্রিত হয়ে উদযাপন করেন। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এটি এমন একটি দিন যা বই পড়া, শেখার এবং ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ উদযাপন করে। বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম বাণী ‘তুমি পড়’ এর কথা সর্বজনবিদিত। কোরআন আরও বলেছে, ‘যে জানে আর যে জানে না তারা সমান নয়’। আর জানতে হলে বই পড়তে হবে।  

আমাদের করণীয়: বাংলাদেশকে ‘বিশ্ব জ্ঞান সূচকে ঈপ্সিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে (২০২৪ সালে বিশ্ব জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ’র স্থান বিশ্বের ১৪১টি দেশের মধ্যে ১১২তম) শিক্ষার  সর্বস্তরে পড়াশুনার মান আমাদের বাড়াতেই হবে সেই সাথে প্রযুক্তির ব্যবহার। পড়াশোনার মান তখনই বৃদ্ধি পাবে যখন ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে গিয়ে বিষয়সংশ্লিষ্ট পুস্তকের অতিরিক্ত রেফারেন্স বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সেই সাথে অনলাইনে শিক্ষক প্রদত্ত ওয়েবসাইট (একাধিক হতে পারে) ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের জ্ঞানস্তরকে সমৃদ্ধ করবে। অপ্রিয় হলেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উচ্চ জিপিএ অর্জন করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই পাঠক্রমের উপর করা প্রশ্নপত্রের উত্তরে খারাপ ফলাফল করছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে – আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগারে পড়াশুনা, রেফারেন্স বই পড়া, ওয়েবসাইট সার্চ করে পড়াশুনা তো দূরের কথা – নিজেদের পাঠ্যপুস্তকও সঠিকভাবে পড়ে আয়ত্ত করেন নাই। তারা গাইড বা নোট পড়ে পাশ করেছেন।

এ অবস্থায় ‘বিশ্ব বই দিবসে’ আমাদের পরামর্শ হচ্ছে– ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনায় মনোনিবেশ করানো– শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোন কে অর্থবহ কাজে লাগানো। প্রতিটি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সরকার নির্দেশিত লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা (ওবিই) বাস্তবায়নের জন্যে ছাত্রছাত্রীদের  গ্রন্থাগারের প্রতি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সর্বস্তরে লক্ষ্যভিত্তিক গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সরকার বিবেচনা করতে পারেন   

শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। জিডিপি’র ২.৫%-৩.০০% করা যায় কিনা, (চলতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে ব্যয় জিডিপি’র ১.৮৩%)। স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা পর্যায়ের গ্রন্থাগার পরিচালনা ও এর ব্যবহার যথাযথ হচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা; এমপিওভুক্তির সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে লিখিত নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে তারা যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; বৈশ্বিক র‍্যাংকিং এ যথাস্থানে (উচ্চস্থান) অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে টার্মস অব রেফারেন্স সহ একটি সেল তৈরি করা এবং এর কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করা; পিতামাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ছোটদের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখা তারা তাদের সময়ের কত অংশ বই পড়ায় এবং কত অংশ ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যয় করছে এবং বিপজ্জনক হলে তাতে হস্তক্ষেপ করে বাচ্চাদের পরিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম (ওবিই) বাস্তবায়নের মাধ্যমে গুণগত শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence