বই উৎসব ও বই প্রেম

  © টিডিসি ফটো

আজ বই উৎসব। শিক্ষান্বেষী সোয়া চার কোটি কোমলমতি ছেলে-মেয়ে নতুন বইয়ের গন্ধে আজ বিভোর। নতুন দিনের এক স্বপ্নের হাতছানিতে এগিয়ে যাবে তারা। এত শিশুর হাতে একসঙ্গে বই তুলে দেওয়া নিঃসন্দেহে এক মহাযজ্ঞ। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে ‘বই উৎসব’ বলা হচ্ছে। নতুন দিনে সরকারের খুব প্রশংসা করছি।

প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় ওমর খৈয়ামের কথা জেনেছি। তিনি বলেছিলেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়’। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি।

আর খৈয়াম তো ছিলেন মুসলমান। মুসলমানদের পয়লা কেতাব কোরানের সর্বপ্রথম যে বাণী মুহম্মদ সাহেব শুনতে পেয়েছিলেন তাতে আছে ‘আল্লামা বিল কলমি’ অর্থাৎ আল্লা মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন ‘কলমের মাধ্যমে’। আর কলমের আশ্রয় তো পুস্তকে।

সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার বই পাচ্ছে বাংলা ভার্সনে জেলায় ১৪ শত ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্যান্য মিলে মোট ২ হাজার ৬ শত ৬০টি বিদ্যালয়ের ৫ লাখ ৩২ হাজার ৪৩ শিক্ষার্থী এবং ইংরেজি ভার্সনের ৩২টি বিদ্যালয়ের মোট ৬ হাজার ২ শত ৬৭ শিক্ষার্থী

এছাড়া বইয়ের চাহিদা ছিলো জেলায় বাংলা ভার্সনে মোট ২৫ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩ শত ৩৪ টি। ইংরেজি ভার্সনে ২৮ হাজার ৮ শত ৬০ টি বইয়ের চাহিদা ছিলো। চাহিদার সাথে প্রাপ্তির পরিমাণও সমান বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. উবায়দুল্লাহ।

তিনি জানান, গত ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে সকল বিদ্যালয়ে চাহিদা অনুযায়ী বই পৌঁছে গেছে। যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসি না। গত ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে বই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এবার জেলা ও উপজেলা পর্যায় ১ জানুয়ারি সকালে বই উৎসবের উদ্বোধন হয়ে দিনের ভিতর বিদ্যালয় পর্যায় সকল শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আমাদের বইয়ের কাছে যেতে হবে বারবার। আজকের এ উৎসব এবং এ উৎসব থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে আমাদের , এ প্রজন্মের । এখন একটা অসাধারণ স্কুলের গল্প বলে শেষ করি। ক্রনিকালস অব নার্নিয়া, মাইকেল ক্লেটন, বার্ন আফটার রিডিং, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, ওকজা—এমন সব ছবির অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন। জিতেছেন অস্কার, বাফটাসহ আরও অনেক পুরস্কার। তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। তবে সিনেমার কথা বলতে নয়। একটা আজব স্কুলের গল্প শোনাতে। যে স্কুলে শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্লাস করে মাটিতে বসে লম্বা লম্বা গাছের দিকে তাকিয়ে। আর বিদ্যুৎ, আলো, বাতি সম্পর্কে জানে অন্ধকার ঘরে বসে। সে স্কুল স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে এক পাহাড়ের ওপর, নাম ড্রামডুয়ান স্কুল।

ব্রিটেনে সবচেয়ে নামীদামি স্কুলে পড়েছেন হলিউড অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন, যেখানে তাঁর বন্ধু ছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এ অভিনেত্রী সুযোগ পান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন সমাজবিজ্ঞান আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। কিন্তু এরপর তাঁর ভেতর জন্মায় প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থাবিরোধী মনোভাব। এসব বড় প্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীকে জীবনে নিঃসঙ্গ করে দেয়, আলাদা করে দেয় সৃজনশীল চিন্তা থেকে—এমন ধারণা দানা বাঁধে তাঁর মনে। সেই ধারণার বীজ থেকেই জন্ম ড্রামডুয়ান স্কুলের। এক অদ্ভুত স্কুল ।

এ অভিনেত্রীর দুই যমজ সন্তান অনার ও জ্যাভিয়ার, এই ড্রামডুয়ান স্কুলেই পড়েছে। দুই সন্তানকে টিলডা মজা করে বলেন, ‘আমার স্বপ্নের স্কুলের গিনিপিগ! হ্যাঁ, গিনিপিগই বলতে হয়। কারণ, আজব স্কুলের অদ্ভুত সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও গবেষণার উপকরণ হয়েছে তারা।’

আজব স্কুল বলছি, কিন্তু কেন? এবার তাহলে সেটা জানা যাক। ড্রামডুয়ান স্কুলে কোনো বই-খাতা নেই। এই স্কুলে হয় না কোনো পরীক্ষা, দেওয়া হয় না ফলাফল। সাত বছরের আগে এই স্কুলের কোনো শিক্ষার্থীকে শেখানো হয় না পড়া কিংবা লেখা। সাত বছর পর্যন্ত তারা শেখে কীভাবে খেলতে হয়, বন্ধু বানাতে হয়, ঝগড়া বাধলে কীভাবে মীমাংসা করতে হয়। শেখানো হয় ছবি আঁকা, গাছে চড়া, পাতা দিয়ে বাঁশি বানানো ইত্যাদি। টিলডা আমাদের শোনালেন এক মজার গল্প। তাঁর দুই যমজ সন্তানের বয়স যখন সাড়ে ছয়, তখন টিলডার বাবা এসেছিলেন তাঁদের বাসায়। নাতি-নাতনিদের একটা কবিতা পড়ে শোনাতে বললেন তিনি, তখনই লজ্জায় নাক কাটা যাওয়ার অবস্থা হয় ওই হলিউড নায়িকার। কারণ কোনো অক্ষরই তো চেনে না তাঁর বাচ্চারা। কিন্তু ৭ বছর বয়সে যখন অনার ও জ্যাভিয়ার পড়া ও লেখা শুরু করে, ঠিক ৩ মাসের মাথায় গড়গড় করে কবিতা-গল্প-গান সব পড়ায় পারদর্শী হয়ে ওঠে তারা।

ড্রামডুয়ান স্কুলে একটা দারুণ নিয়ম আছে। তা হলো ১৬ বছরের আগে এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের ডিজিটাল পর্দায় চোখ রাখতে পারে না। অর্থাৎ টিভি, কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ তো দূরে থাক, মুঠোফোন এমনকি ক্যালকুলেটরও ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না তাদের। তারা বরং সেই সময়টায় শেখে কীভাবে বাড়ি বানাতে হয়, গাছ কাটতে হয়, সেই গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা বানাতে হয়, সবজি ফলাতে হয়। এর ফলে কি এ যুগের ছেলেমেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে না ড্রামডুয়ানের শিক্ষার্থীরা? টিলডাকে এমন প্রশ্ন করেন ঢাকার উৎসাহী এক অভিভাবক। টিলডার জবাব, ‘মোটেও না। আমার বাচ্চারা আমাকে বলে, তুমি তো ফোন ছাড়া কী করে বাঁচতে হয় জানো না। কিন্তু আমরা জানি। কাল কোনো দুর্যোগে যখন ফোন, ইন্টারনেট, ইলেকট্রিসিটি কিছু থাকবে না, তখন কী করে টিকে থাকতে হবে, এটা ড্রামডুয়ানের সবাই জানে।’

টিলডা জানান, তাঁর স্কুলে ভালো ফলাফলের জন্য কোনো পুরস্কার দেওয়া হয় না। তবে কেউ যদি বন্ধুকে সাহায্য করে, বন্ধুরা এক হয়ে বানায় কোনো নতুন নৌকা বা কাঠের ঘর, তখন তাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য মাটি দিয়ে হাতে তৈরি মেডেল দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বয়স ১৯–২০ হলে তাঁদের শিক্ষাজীবন নিয়ে তৈরি করতে বলা হয় একটি থিসিস পেপার। সেই গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই ড্রামডুয়ানের প্রথাবিরোধী শিক্ষার্থীরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। কেউ চলে যান স্থাপত্য বিষয়ে পড়তে, কেউ পড়তে যান মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ আবার চিত্রকলা আর লেখালেখিতে থিতু হন।

টিলডা বলেন, ‘আমার গিনিপিগেরা, মানে আমার সন্তানেরা এখন নিজ নিজ ক্যারিয়ারে বেশ ভালো করছে। আমার মেয়ে পড়ছে মনোবিজ্ঞান নিয়ে, আর ছেলে প্রকৌশল বিষয়ে। যতটা তাদের নিয়ে চিন্তা করা হয়েছিল, ততটা উচ্ছন্নে তারা যায়নি। আমার গবেষণা সফলই হয়েছে বলা যায়।’

টিলডা জানান, তাঁদের ড্রামডুয়ান স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থার মডেল বিভিন্ন দেশের স্কুলগুলো গ্রহণ করছে। কিন্তু স্বপ্নের স্কুলের ভাবনা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে আরও। চলো, এ প্রজন্ম কে বইয়ের কাছে যেতে উৎসাহিত করি। 

লেখক: প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রী কলেজ, সিলেট।
এমফিল গবেষক , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence