অরিত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষকেরাই দোষী?

অরিত্রী অধিকারী
অরিত্রী অধিকারী  © ফাইল ফটো

আমি কন্যাসন্তানের বাবা। কন্যাদের স্কুলে নিয়ে যাই, স্কুল থেকে আনি, পড়াই, খেলি তাদের সঙ্গে। গর্ব করে বলি, আমি একজন ফুলটাইম বাবা।

আমার মতো একজন মানুষের পক্ষে অকালে কোনো সন্তানের মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কঠিন। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর মৃত্যুও আমাকে প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত করেছে। কিন্তু আমি মনে করি, এ জন্য শুধু শিক্ষকদের যে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে, যেভাবে তাঁদের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে গালাগাল করা হচ্ছে, যেভাবে জনমতের চাপে তদন্ত ছাড়া তাঁদের বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।

পরীক্ষা হলে নকল করলে বা শুধু মোবাইল নিয়ে এলেও আমি ছাত্রছাত্রীদের বকা দিই। আমার হাতে নকলের জন্য বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। আমি স্কুল টিচার হলে, স্কুলে নিয়ম থাকলে হয়তো এমন কোনো ছাত্রছাত্রীকে টিসি দেওয়ার কথাও বলতাম। এটা নিয়ম, বহু দেশের নিয়ম।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নিয়মাবলিতে পরিষ্কারভাবে মোবাইল নিয়ে এলে টিসি দেওয়া হতে পারে বলা আছে। অরিত্রী মোবাইল নিয়ে এসে পরীক্ষা হল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, তার বাবা-মা তিরস্কৃত হয়েছেন, তাকে টিসি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এসব তো অস্বাভাবিক নয়। অরিত্রীদের বকাবকি মাত্রছাড়া হয়ে গেছে, অবশ্যই তাদের প্রতি আরও মানবিক হওয়া যেত, এমনকি সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া যেত। অরিত্রীর শিক্ষকেরা মানবিক হননি। কঠিনভাবে নিয়মের প্রয়োগ করেছেন, আমাদের সমাজের রীতি অনুসারে অভিবাবকদের ডেকে পাঠিয়েছেন। অপমানজনক কথাও বলেছেন। কিন্তু এ জন্য কি তাঁরা অরিত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচক হয়ে গেলেন?
আমি ছোটবেলায় স্কুলে বহুবার মার খেয়েছি। আমার এক কাজিনের কারণে তার বাবাকে কয়েকবার স্কুলে ডেকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে, পরে সে স্কুল থেকে তাকে বেরও করে দেওয়া হয়েছে।

আমি বা আমার কাজিন আত্মহত্যা করিনি। অরিত্রী করেছে। আমার মতে, অরিত্রীর প্রতিক্রিয়াটা খুব স্বাভাবিক নয়। আমরা কি কখনো ভেবে দেখতে পারি কেন সে এমন অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করল? পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী বা স্কুল প্রশাসন—কোন প্রতিবেশের কারণে সে পরীক্ষা হলে পরিষ্কার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মোবাইল ফোন নিয়ে গেল? আমরা কি ভেবে দেখতে পারি, অরিত্রী কি শুধু বাবা-মা এবং নিজে অপমানিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আত্মহত্যা করল, নাকি পেছনে আরও বহু মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ছিল? সংবাদটা পাওয়ামাত্র শিক্ষকদের ওপর ঢালাওভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে একটু অপেক্ষা করলে, সুষ্ঠু তদন্ত করতে দিলে ভালো হতো না? 
আরেকটা কথা। গত এক বছরে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আটজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যাকারী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন না হলে সব আত্মহত্যার পেছনে কোনো না কোনো প্ররোচনা থাকে। আমার জানামতে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেউ মানসিক রোগী ছিল না। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে বারবার সরকারি চাকরিতে সব পরীক্ষায় খুব ভালো করার পরও মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে।

কীভাবে এবং কাদের এখন এসব পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হয়—এ নিয়ে বহু কথা শোনা যায়। কিন্তু আমরা কি আমাদের ছাত্রদের করুণ আত্মহননের জন্য ঢালাওভাবে কাউকে দায়ী করেছি কখনো? আমরা এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের বারান্দার ঠান্ডায় মরে যাওয়া বা হলের ভেতর গুলি খেয়ে খুন হওয়া ছাত্রদের করুণ অপমৃত্যুর জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককে দায়ী করেছি? এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাজনিত প্ররোচনা ছিল না আমাদের কারও? কেউ কি চাকরি হারিয়েছে বা গ্রেপ্তার হয়েছে এ জন্য? আমরা বিভিন্ন ঘটনায় ভিন্নভাবে খুবই প্রতিক্রিয়া দেখাই। কেন আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

অরিত্রীর জন্য ভালোবাসা, আমার ছাত্রদের জন্য ভালোবাসা। কিন্তু আমি আমাদের সন্তানসম এদের সবাইকে এটাও বলতে চাই, কাজটা ঠিক করোনি মা, ঠিক করোনি বাবা!

জীবন তো ম্যারাথন। এক শ মিটারে পিছিয়ে থাকলে থেমে বসে পড়লে হয় না। ঠিক তেমনি একটা বিপর্যয়ে ভেঙে পড়লেও চলে না। সামনে থাকতে পারে অনেক সুদিন। এটা মনে রাখতে হবে। 

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।


সর্বশেষ সংবাদ