জুলিও কুরি পদকে ভূষিত বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তির অগ্রদূত
- অধ্যাপক ড. কে. এম. সালাহ উদ্দিন
- প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০১ PM , আপডেট: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০১ PM
মহাকালের এই অনন্তযাত্রায় লক্ষ-কোটি মানুষের পদচারণা হয় এই ধরণীতে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম আর কর্মফল দিয়ে বেঁচে থাকেন অনন্তকাল। তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এমনই এক মহামানবের জন্ম হয় পদ্মা নদীর ঢেউ খেলানো পাড় ঘেঁষে; বুক ভরা সাহস, জুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে অগ্নিঝরা কণ্ঠ এবং যার নামে এই বাংলার ইতিহাস- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ চার পাশে দ্যুতি ছড়িয়ে জন্মনেন এই বাংলায়। মা-বাবার আদর করে ডাকা ‘খোকা’ একদিন হয়ে ওঠেন বিশ্বনন্দিত নেতা, বাঙালী জাতির পিতা।
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, যার সম্পর্কে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে ছিলেন- আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।
অন্নদাশঙ্কর রায় গৌরী যমুনার বিশালতায় মিশিয়ে শেখ মুজিবকে উপলব্ধি করে ছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি- "যত কাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান"।
বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সর্বদায় ছিলো শোষিত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সোচ্চার। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আলজিয়ার্সের জোট-নিরপেক্ষ সন্মেলনে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলে ছিলেন- "বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে"।
বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা " বঙ্গবন্ধু " তো হয়ে ছিলেন ১৯৬৯ সালেই, এরপর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান "জুলিও কুরি" নামক শান্তি পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে। বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র এই পদক পরিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুকে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বপদকের ৫০ বছর পূর্তি
জুলিও-কুরির জন্ম ১৯ মার্চ, ১৯০০ সালে এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৪ জুলাই ১৯৫৮ সালে। ফ্রান্সের প্যারিসে জন্ম গ্রহণকারী জুলিও-কুরি ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি এবং তার স্ত্রী যৌথ ভাবে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কারের ফলে ১৯৩৫ সালের সায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। জুলিও কুরি প্যারিস বিজ্ঞান অনুষদে প্রভাষক থাকাকালীন তার স্ত্রীর সঙ্গে পরমাণু গঠন সম্পর্কীয় গবেষণায় মনোনিবেশ করেন ঠিকই; কিন্তু মানুষের জন্য তার সংবেদনশীল মনে সব সময়মই তিনি একটি আন্তরীক টান অনুভব করেন।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসন তিনি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার হিংস্রতা প্রতি রোধে নানান চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি গঠন করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ। বিশ্ব শান্তি পরিষদ একটি প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ জুলিও কুরি বিরোধী একটি সংস্থা। বিশ্ব শান্তি পরিষদ যাত্রা শুরু করে ১৯৪৯ সালে কিন্তু পদক প্রদান শুরু করে ১৯৫০ সাল থেকে। জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করার পর ১৯৫৯ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ এই শান্তি পদকের নাম রাখে ‘জোলিও কুরি’। এই পরিক্রমায় অসীম সাহস, তেজোদীপ্ত কণ্ঠ আর ঈর্ষণীয় বিচক্ষণতা, সাম্যবাদ এবং বিশ্ব শান্তির দর্শন বিবেচনায় বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু নাম লিখিয়ে নেন বিশ্ব নেতার কাতারে।
বঙ্গবন্ধু ছাডাও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তানের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং।
বঙ্গবন্ধু সব সময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তিনি আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উখাতের নিন্দাও করেছেন। ভিয়েত নামে আমেরিকার বোমা বাজি বন্ধের দাবিও জানায় বাংলাদেশ তার আমলেই।
মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে এবং স্বীকৃতি প্রদান করে আরো বিভিন্ন মুখী সহযোগিতার। এ সময় বাংলাদেশ এডিবি, আইসিএও, ইকাফ ও এফএওর সদস্য পদ লাভ করে।
‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান’। বঙ্গবন্ধুর এই শান্তির বার্তায় আজ বাংলাদেশের কুটনীতির মূলনীতি। বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির কৌশলে কারণে আমরা বলতে পারি তিনি বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত। পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর-ই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছেন। দেশ এখন তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে রোল মডেল। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে স্মার্ট বাংলাদেশের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তিনি , ঘটিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব।
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। তিনি জীবন দিয়েছেন কিন্তু আপসের পথে হাঁটেননি। বঙ্গবন্ধুর শরীরী উপস্থিতি আমাদের সঙ্গে নেই, কিন্তু তার আদর্শ আছে। যদিও এখন বিশ্বব্যাপী রাজনীতির ধরন এবং প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। শোষিতের পক্ষের বিশ্বশক্তি দুর্বল। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযেগিতা চলছে। শান্তির ললিত বাণী পরিহাসের মতো শোনায়। তারপরও বলতে ইচ্ছে হয়, হাল ছেড়োনা বন্ধু...জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর "জুলিও কুরি" শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির এই দিনে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়