৯ দশকেও আবেদন হারায়নি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...’
- সুপান্থ মলিক
- প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৬ PM , আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:২১ PM
বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের দিন, চিত্তে আজও আনন্দ বাড়িয়ে দেয় আমাদের জাতিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাংলায় লেখা বিখ্যাত এই অতি জনপ্রিয় ইসলামী সংগীত খানা। এজন্য তিনি আজও সমকালীন! তিনি এদেশের মাটির কুঠিরে শুয়ে দূর আরব ও ইসলামী সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখেছেন, ভেবেছেন এবং লিখেছেন; তাঁর কবিতা, গান, হামদ্-নাত ও উপন্যাসে আরবি ও ফার্সি ভাষার শব্দমালা ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। বাংলা কবিতায় বিদেশী ভাষা সার্থক প্রয়োগ করে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও বিরল! এতে বিশ্ব সাহিত্যে, বাংলা সাহিত্যের যেমন শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে; তেমনি ভাব-গাম্ভীর্যে হয়েছে অনন্য। এখানেই নজরুলের বিশেষত্ব!
নজরুল বাংলায় ইসলামী গান প্রথম লেখেন ১৯৩২ খৃস্টাব্দের শুরুতে। আজ থেকে ৯১ বছর আগের কথা! তিনি সানন্দে লিখলেন, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ”। পরের দিন লিখলেন, “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর”। এর চার দিন পর ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে এইচএমভি থেকে রেকর্ড করা গান দুটি বাজারে এলো। গান দুটি ব্যাপক সাড়া জাগালো বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে এবং জনপ্রিয়তায় অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল, তাঁকে।
নজরুল গীতি ‘অখণ্ড’ গ্রন্থে আবদুল আজিজ আল আমান ৫৩৭ পৃষ্ঠায় গান দুটির উৎস সম্পর্কে বলেন, উর্দু ও কাওয়ালী গানের রেকর্ড হাজার হাজার বিক্রি হলেও বাংলা ইসলামী গানের রেকর্ড বিক্রি হবে না- এরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তৃপক্ষের মাথায় বাসা বেঁধে ছিল। এরকম ধারণা করার কোন সঙ্গত কারণই ছিল না। কেননা বাজারে তখন বাংলা ভাষায় ইসলামী গানের একটি রেকর্ডও ছিল না। দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় আব্বাস উদ্দিন আহমদ একটি রেকর্ড করার অনুমতি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আদায় করে নিয়ে এলেন। এখন চাই সংগীত, সঙ্গে সুরও! বাংলা ভাষায় তখন ইসলামী গানের প্রচলন হয়নি! তিনি গিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে সব কথা খুলে বললেন এবং গানের জন্য অনুরোধ জানালেন! সবকথা শুনে কবি খুশীই হলেন।
আব্বাস উদ্দিনকে বসিয়ে রেখে অল্পক্ষণের মধ্যেই লিখে ফেললেন, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ” এই অপূর্ব গানটি। বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ইসলামী সংগীত। সুর দিলেন কবি নিজেই। কিন্তু একটি গানে এক পিঠে রেকর্ড হয়? আবার ইসলামী গানের সঙ্গে তো অন্য গান দেয়া মানায় না! তাহলে? কবি, পরের দিন আবার আব্বাস উদ্দিনকে আসতে বললেন। এবং একই ভাবে তাঁকে বসিয়ে কবি লিখলেন, “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর”। সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন, আব্বাস উদ্দিনকে। ঠিক চারদিন পরে গান দুটি রেকর্ড করা হল। এবং বাজারে বেরিয়েই, বাংলার আকাশে- বাতাসে ও প্রত্যেক মুসলমানের ঘরে ঘরে এই রেকর্ডটি তৎকালীন সময়ে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যা আজও বাঙালি মুসলমান সমাজের সকলের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, একই ভাবে উলসিত ও আলোড়িত করে।
ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে- ইসলাম ধর্মে মূল পাঁচটি ফরজের একটি হল, রমজান। এই রমজান মাসের ২৭ তারিখের রাতে, আল্লাহ মুসলমানদের শেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মাদ (সা:)র মাধ্যমে কুরআন নাজিল করেন। এই মহা-পবিত্র রাতকে বলা হয়, লাইলাতুল কদর। মুসলমানদের জন্য এই রাতের গুরুত্ব অপরিসীম, এই রাতের ইবাদত হাজার রাতের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। রমজানের ফজিলত অনেক। এই মাসে মুসলমানরা রোজা রাখেন, মুসলমানদের জন্য এই মাসটি আত্মশুদ্ধির ও সংযমের মাস। প্রকৃত রোজাদারগণ আল্লাহর কাছে পূর্ববর্তী গুনাহ্ জন্য মাফ চাইলে আল্লাহপাক মাফ করে দেন এবং প্রতিদান দেন।
হিজরি সনের রমজান মাস এলে সারা দুনিয়ার মুসলমান সমাজে এমন একটা ভাব-গাম্ভীর্য জেগে ওঠে যা অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের নজরে পড়ে! এই চন্দ্র মাসে মুসলমানরা চেষ্টা করে গুনাহ্ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকতে। প্রকৃত ধার্মিকগণ বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এই রমজান মাসকে, নামাজ- রোজার নিয়ম নীতি পালনে কোন গাফলতি করেন না। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্পাক এই রমজান মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখেন। এজন্য মুসলমানদের কাছে অন্যান্য মাসের চেয়ে এই মাসের গুরুত্ব বেশী। কারণ, এ মাসে নেক কাজ ও ইবাদতের সোয়াব অনেক বেশী! রমজান এলে নতুন করে সাজানো হয় জান্নাত। তালা দেয়া হয় দোজখের দুয়ারে।
রমজানের বরকতপূর্ণ ও তাৎপর্যময় মাসের ওপর জাতীয় কবি নজরুলের ৫টি গান পাওয়া যায়। দুটি রমজানের আগমন উপলক্ষে ও বাকী তিনটি বিদায় উপলক্ষে লেখা। তাঁর প্রথম দুটি গান- (১) এল রমজানের চাঁদ এবার দুনিয়াদারী ভোল/ সারা বরষ ছিলি গাফেল এবার আঁখি খোল/ এই এক মাস রোজা রেখে পরহেজ থাক গুনাহ থেকে/ কিয়ামতের নিয়ামত তোর ঝুলি ভরে তোল। (২) নতুন করে রেজওয়ান জান্নাত সাজায়- আজ রোজায়/ লাগলো চাবি দোজখেরই দরওজায়- আজ রোজায়/ মসজিদের মিনার চুড়ে আজ বেহেশতী নিশান উড়ে/ গাফলতি নাই আর কারো নামাজ কাজায়- আজ রোজায়।
রমজান মাসে রোজার কষ্ট শেষে নেক মুসলমানদের জন্য আসবে, আনন্দ ও উৎসবের পবিত্র ঈদ উল ফিতর। যা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটি। চলমান রমজান মাস মুসলমানদের মনে লেগে থাকে কেমন যেন একটা উদাস উদাস ভাব। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসে রমজান মাসের ৩০ দিন। যাবার সময় হয়ে আসে রমজানের, বিদায় ব্যথায় কাঁদে ধার্মিক মুসলমানগণ! তাই পবিত্র রমজানের বিদায় উপলক্ষে কবি নজরুল লেখেন- (১) ফুরিয়ে এল রমজানেরই মোবারক মাস/ আজ বাদে কাল ঈদ তবু মন করে উদাস। (২) যাবার বেলায় সালাম লহ হে পাক রমজান/ তব বিদায় ব্যথায় কাঁদিছে নিখিল মুসলিম জাহান। (৩) বিদায় বেলায় সালাম লহ মাহে রমজানের রোজা/ তোমার ফজিলতে হালকা হলো গুনাহের বোঝা।
কাজী নজরুল কি শুধু রোজা ও ঈদকে নিয়ে ইসলামী গান রচনা করেছেন? না! তাঁর লেখায় ইসলামী গানে উঠে এসেছে- মুহাম্মাদ(সা:), মহরম, জাকাত, হামদ, নাথসহ আরও অনেক জনপ্রিয় গান লিখেছেন। যা এদেশের রাষ্ট্র, মুসলিম পরিবার ও সামাজিক অনুষ্ঠানমালায় আজও সমান জনপ্রিয়। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রযুক্তির নতুন উদ্ভাবনে নজরুলের অমর এই গান- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ” জনপ্রিয়তায় উঠছে তুঙ্গে আর প্রচারের পরিধি এখন বিশ্বব্যাপী! বাংলাদেশে ঈদ উৎসব রাষ্ট্রীয় ভাবে পালিত হয়, ঈদ এদেশে সার্বজনীন এক মহাউৎসব। ঈদের আগে চাঁদ রাত থেকে শুরু করে ঈদ উৎসবের দিন পর্যন্ত- এই গানটি, রাষ্ট্র সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে ঈদের বর্ণিল উৎসবকে আরও আনন্দময় করতে- “ঈদ থিম সং” হিসেবে সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। যা কিনা বাংলাদেশী বাঙালিদের জন্য অত্যান্ত গর্বের বিষয়। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী গান কাজী নজরুলের এক বিশেষ অবদান, এক নতুন ধারার প্রবর্তন। নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন তিনি।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, বাংলা সাহিত্যের অমর এই কবি ১৯৪২ সাল থেকে চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে নির্বাক হয়ে যান! ১৯৭২ সালের ২রা মে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে অসুস্থ ও নির্বাক কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এবং নজরুলকে এদেশের জাতিয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে, ঢাকার ধানমন্ডিতে কবি ভবন ও তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নং কেবিনে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রবিবার সকাল ১০টা ১০মিনিটে পিজি হাসপাতালে, পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি! কবির কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছানুসারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। যার জন্য বাংলাদেশী বাঙালি মুসলিম সমাজ তাঁর কাছে, আজও ঋণী! তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য। সকল পাঠককে ঈদ মুবারক।।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক