টাকা নিয়ে বিপাকে দুর্নীতিবাজ নেতারা
যুবলীগের তিন নেতার বাড়িতে টাকা গোনার মেশিন, পালিয়েছেন ৪০০ নেতা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:০৩ AM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:০৩ AM
অবৈধ টাকা রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতারা। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ায় এই দুর্নীতিবাজ নেতারা এখন বিপাকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, এটা তাদের ধারণাতেই ছিল না।
তাই অনেকে বস্তায় ভরে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনের কাছে। আর কেউ কেউ নিজেকে রক্ষা করতে টাকা নষ্ট করে ফেলে দিচ্ছেন। আবার টাকা রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের চার শতাধিক নেতাকর্মী। এছাড়া এই মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন ছয় শতাধিক নেতাকর্মী। আবার অনেকে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
রাজনীতির নামে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তির প্রয়োগসহ যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে শুদ্ধি অভিযান। এ অভিযানের ফলে দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম করে দলের ইমেজ ক্ষুণ্নকারী নেতাকর্মীরা আছেন ‘দৌড়ের ওপর।
অভিযান থেকে বাদ পড়বেন না আমলারাও। দুর্নীতিবাজ আমলাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দুই বছর আগে থেকেই বিতর্কিতদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এদিকে গতকাল ঢাকার গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই, তাদের এক কর্মচারী এবং তাদের এক বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা, আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাব। ক্যাসিনো থেকে আয়ের টাকা এনামুল বাসায় সিন্দুক ভরে রাখতেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুবলীগের তিন নেতার বাড়িতে রয়েছে টাকা গোনার মেশিন। প্রতিদিন অনেক টাকা একসঙ্গে অল্পসময়ে গুনতে গুনতে ক্লান্ত ও বিরক্ত হওয়ারই কথা! এরপর আছে জাল নোটের ভয়। তাই যুবলীগের ঐ তিন নেতা ক্রয় করেন মানি কাউন্টিং অ্যান্ড নোট ডিটেক্টিং মেশিন, যা তাদের সময় ও পরিশ্রম বাঁচিয়ে দেয়। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, পদ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের মোটা অঙ্কের টাকা যেত ঐ তিন নেতার কাছে। সাত বছর আগেই তারা কিনে নেন টাকা গোনার মেশিন। অটোম্যাটিক মানি কাউন্টিং অ্যান্ড ফেইক নোট ডিটেক্টিং মেশিন দিয়ে এক বান্ডিল নতুন অথবা পুরোনো টাকা (২ টাকার নোট থেকে ১০০০ টাকা নোট পর্যন্ত) মাত্র ৬ সেকেন্ডে গণনা করা যায়।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান এবং সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য—এই দুই জন যুবলীগের শীর্ষ এক নেতার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত, যে নেতার বাড়িতে রয়েছে টাকা গোনার মেশিন। তবে আনিস এবং ঐ নেতা দুই জনই প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সব কমিটির পদ-বাণিজ্যের টাকা আনিসের মাধ্যমে যুবলীগের শীর্ষ এক নেতার কাছে যেত। কথার সঙ্গে কাজে মিল থাকায় আনিস হয়ে ওঠেন অনেক ক্ষমতাধর। কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকে তিনি পাত্তা দিতেন না। এমনকি অনেক মন্ত্রী-এমপিকেও তিনি অগ্রাহ্য করতেন। আনিসের দেওয়া টাকা মেশিনের মাধ্যমে গুনে নিতেন শীর্ষ ঐ নেতা। তার টাকা গোনার মেশিনের বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতার বিষয়টি জানার আগ্রহ ছিল। এ কারণে রাজধানীর একটি ওয়ার্ডের সভাপতি পদপ্রার্থী পদটি পেতে তাকে ৬ লাখ টাকা দেন। তবে দুটি ব্যান্ডেলে একটি করে দুটি ১ হাজার টাকার নোট কম দেন। বিষয়টি ধরা পড়ে মেশিনে। পরদিন শীর্ষ ঐ নেতা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে বিষয়টি জানিয়ে বলেন, দুটি ব্যান্ডেলে ২ হাজার টাকা কম ছিল।
এসএসসি পাশ কাজী আনিসুর রহমান যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিয়ন ছিলেন। ২০০৫ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে ঐ চাকরি পান তিনি যুবলীগের সাবেক এক সভাপতির হাত ধরে। যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেওয়ার পাশপাশি এখন তিনি ৩০০ কোটি টাকার মালিক। অফিসের পিয়নের কাজের পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন তিনি। এতে করে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কার্যালয়ে আসা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও পরিচয়ের সুযোগ হয় তার। কম্পিউটারে নিয়মিত সারাদেশের সব যুবলীগ কমিটির তালিকা তৈরি করতে গিয়ে সব তথ্য তার নখদর্পণে চলে আসে। মুখস্থ বলে দিতে পারতেন যে কোনো কমিটির নেতার নাম। ২০১২ সালে যুবলীগের নতুন কমিটি গঠনের সময় তিনি নিজেও আনিসকে একটা সদস্যপদ দিতে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু আনিস পেয়ে যান উপদপ্তর সম্পাদকের পদ। দপ্তর সম্পাদক পদটি শুরু থেকেই খালি ছিল, ছয় মাসের মধ্যেই সেটাও পেয়ে যান। আনিস থাকতেন টিকাটুলী এলাকায়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার পর ধানমন্ডিতে ভাড়া বাসা খোঁজেন। কিন্তু ভাড়া না নিয়ে ১৫ নম্বর সড়কে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনে নেন। এখানেই আছেন প্রায় সাড়ে তিন বছর। বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডির ১০/এ সড়কের এক বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকেন কাজী আনিস। পাঁচ বছর আগেও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে টিনের ঘরে থাকা আনিসুরের বাড়িতে এখন সুরম্য অট্টালিকা। ময়মনসিংহের ভালুকা, ঢাকার স্বামীবাগ, ইত্তেফাক মোড়, যাত্রাবাড়ী, শুক্রাবাদ, উত্তরায়ও বাড়ি আছে তার। এছাড়া লালমাটিয়া, ঝিগাতলা ও ধানমন্ডিতে আছে কয়েকটি ফ্ল্যাট। উত্তরা, মিরপুর ও গুলশানে মার্কেটে আনিসের নামে আছে দোকান। নারায়ণগঞ্জের একটি চটের মিলেরও মালিক আনিস।
এছাড়া যুবলীগ অফিসের এক পিয়ন ৯০০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। যুবলীগের শীর্ষ নেতার কোনো কোনো খাত থেকে বা কারা কোটি কোটি টাকা প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে দিয়ে যায় তা আনিসের মাধ্যমেই নেতার কাছে পৌঁছে যেত। এ কারণে আনিসকে পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদকের পদ উপহার দেওয়া হয়।
১৯৯৮ সাল থেকেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ও শিক্ষা ভবনে থাকা ১৪টি প্রকল্পের ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই তার প্রায় ২০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলমান। প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারি আর কমিশন বাণিজ্য করে তিনি এখন প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় রয়েছে সাতটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। ঢাকার দক্ষিণখানে দুই বিঘার ওপর জমিতে বিশাল বাংলো বাড়িতে তিনি থাকেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। সেখানেই শিবিরের হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে ভর্তি হয়ে চলাফেরা করতেন ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগে যোগ দেন ঐ নেতা। এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এর পর থেকেই মূলত তার ‘টেন্ডারবাজি’ শুরু। পরে ২০১৪ সালে অর্থের বিনিময়ে যুবলীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পদ বাগিয়ে নেন তিনি।
রাজধানীর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালানো নিয়ে বিতর্কে আসা ক্লাবের সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ এক নেতা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ক্যাসিনো বিতর্কে জড়িত আরেক নেতা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরছেন না। এক সময় কাউন্সিলর সাঈদ ঢাকায় তেল চুরি করে বিক্রি করতেন। ইতোমধ্যে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগের নামধারী জি কে শামীম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য কলাবাগান ক্রীড়াচক্র সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে শুক্রবার নগরীর কলাবাগান এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। নানা অপকর্মের তথ্য উঠে আসে ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়, যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে শাহাবুদ্দিন এখন শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া ও বঙ্গবাজারের পাঁচটি মার্কেট। আওয়ামী লীগের মহানগরের এক নেতার ক্যাশিয়ারের কাজ করেন তিনি। চাঁদা উঠিয়ে ঐ নেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ তার। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা, সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মহিলা নেত্রী, সচিব, বিভিন্ন প্রকল্পের পিডি, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, অভিনয় জগতের মানুষ সবার নিয়মিত যাতায়াত ছিল বিভিন্ন ক্লাবের ক্যাসিনোতে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবের অভ্যন্তরীণ এসব চিত্র ভিডিওসহ বিস্তারিত প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দিয়েছে। এসব দেখে প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। ফলে চলমান দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে এসব অপকর্মকারীর পালানোর কোনো পথ থাকছে না এবং অস্বীকার করে কিংবা নালিশ বা তদবির করেও বাঁচার সুযোগ নেই।