যন্ত্রের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে হাতে ভাজা মুড়ির শত বছরের ঐতিহ্য

টিডিসি সম্পাদিত
টিডিসি সম্পাদিত

আধুনিক জীবনযাত্রা আর পরিবর্তনের ছোঁয়ায় মান্দাতা আমলের ঐতিহ্য হাতে ভাজা দেশি মুড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা থেকে বিলুপ্তির পথে। যান্ত্রিক ব্যবস্থার জাঁতাকলে আর কালের বিবর্তনে হাতে ভাজা মুড়ি শিল্পটি আজ আর গ্রামের পল্লী-প্রান্তরে তেমন দেখা যায় না। রমজান মাসে মুড়ি ছাড়া ইফতার যেন অকল্পনীয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে এখনো ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মুড়ির কদর। বর্তমানে হাতে ভাজা মুড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে কারখানার মেশিনের তৈরি মুড়ি।

একসময় বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে সারি সারি মাটির চুলায় গরম বালুতে মুড়ি ভাজার দৃশ্য ছিল খুবই সাধারণ। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রের দাপটে হাতে ভাজা মুড়ির কদর এখন কমে গেছে। বাজারজুড়ে সস্তা ও সহজলভ্য যন্ত্রে তৈরি মুড়ির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের পুরোনো পেশা।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শাহা বাড়ি একসময় হাতে ভাজা মুড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল। দুই শতাব্দী ধরে এই এলাকার মানুষ মুড়ি ভাজাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তাদের হাতে তৈরি সোনালি রঙের, সুস্বাদু ও মচমচে মুড়ির চাহিদা ছিল দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

বিশেষ করে রমজান মাসে এ মুড়ির কদর বেড়ে যেত কয়েক গুণ। রাত জেগে কারিগররা মুড়ি ভাজতেন, পাইকাররা সেই মুড়ি কিনে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই দৃশ্যও এখন প্রায় বিলুপ্ত।

আরও পড়ুন: গাজীপুরে গাড়িতে আগুন, কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা

একসময় শাহা বাড়ির প্রায় প্রতিটি পরিবার মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৫-৬টি পরিবার এই পেশায় টিকে আছে। অন্যরা পেশা বদলে কেউ কৃষিকাজে, কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ বা চটপটি-ফুসকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

প্রবীণ মুড়ি কারিগর নিতাই শাহা বলেন, ‘আগে সারারাত জেগে মুড়ি ভাজলেও চাহিদা মেটানো যেত না, কিন্তু এখন কেউ হাতে ভাজা মুড়ি চায় না। পাইকাররা কম দামে মেশিনের মুড়ি কিনে নিয়ে যায়। তাই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।’

গলাচিপার হাতে ভাজা মুড়ি শিল্পে টিকে থাকা কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম চায়না সাহা ও সন্ধ্যা রানী। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা পূর্বপুরুষদের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

চায়না সাহা বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই মুড়ি ভাজছি। আগে দিন-রাত কাজ করেও ভালো আয় হতো। এখন হাতে ভাজা মুড়ির তেমন চাহিদা নেই। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা মেশিনের মুড়ির দিকেই ঝুঁকছে।’

আরও পড়ুন: একটা পলাতক দল দেশকে অস্থিতিশীল করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে

সন্ধ্যা রানী বলেন, ‘মেশিনের মুড়ির কারণে আমাদের মুড়ি বিক্রি হচ্ছে না। অথচ হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদই আলাদা। সরকার যদি আমাদের সহায়তা দিত, তাহলে হয়তো আমরা এই পেশা ধরে রাখতে পারতাম। বর্তমানে প্রতি দেড় কেজি চাল ভাজতে ৩৫ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন মাত্র দেড় থেকে দুই মণ মুড়ি ভাজা হয়, যা আগের তুলনায় অনেক কম। আগে যেখানে প্রচুর চাহিদা ছিল, এখন সেই বাজার প্রায় হারিয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, মুড়ি ভাজার প্রধান উপকরণ কাঠ ও খড়ের দামও বেড়ে গেছে। আগের তুলনায় জ্বালানি খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে, অথচ হাতে ভাজা মুড়ির দাম তেমন বাড়েনি। কারিগরদের মজুরি দিয়ে এখন এই পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করতে চাই। কারণ এর স্বাদ ও গুণগত মান মেশিনের মুড়ির চেয়ে অনেক ভালো, কিন্তু ক্রেতারা সস্তা মেশিনের মুড়ির দিকেই বেশি ঝুঁকছে।’

গলাচিপা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফোরকান কবির মনে করেন, ‘হাতে ভাজা মুড়ি শুধু একটি খাদ্য নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সঠিক বাজারব্যবস্থা ও সরকারি সহায়তার অভাবে এই শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।’

আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে পৌর এলাকায় টিসিবির স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ ও পুষ্টিগুণ মেশিনের মুড়ির তুলনায় অনেক ভালো। এটি সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।

একসময় বাংলার প্রতিটি গ্রামে মুড়ি ভাজার শব্দ শোনা যেত। এখন হাতে ভাজা মুড়ি কেবল কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্য কেবল স্মৃতির পাতায় ঠাঁই পাবে।


সর্বশেষ সংবাদ