অপেক্ষায় মা, বুথে টাকা তুলতে গিয়ে আর ফেরেননি তানভিন

ইঞ্জিনিয়ার জাহিদুজ্জামান তানভিন
ইঞ্জিনিয়ার জাহিদুজ্জামান তানভিন  © সংগৃহীত

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জাহিদুজ্জামান তানভিন স্বপ্ন দেখতেন তার বানানো ড্রোন উড়বে দেশ-বিদেশের আকাশে। রঙিন এ স্বপ্ন নিয়েই মূলত তার বেঁচে থাকা। কিন্তু একনিমেষেই মুখ থুবড়ে পড়লো তার সেই স্বপ্ন। বুলেটের আঘাতে শহীদ হয়েছেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে। প্রিয় সন্তানকে শেষবারের মতো বিদায়ও জানাতে পারেননি মা বিলকিস জামান।

গত ১৮ জুলাই দুপুরে ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে পুলিশ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তানভীন। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পুলিশের গুলি তার গলার পাশ ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। বুকে ছিল অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন।

‘আমার ছেলে এভাবে চলে যাবে, সেটা কখনও কল্পনাও করিনি’, ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা এভাবে দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তানভীনের মা বিলকিস জামান (৪৫)।

জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৪) গৃহিণী মা বিলকিস জামান ও ইঞ্জিনিয়ার বাবা শামসুজ্জামানের সঙ্গে উত্তরার আজমপুর কাঁচাবাজার জামতলার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।

আরও পড়ুন: ডান পায়ে গুলি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে নূপুরকে

ছেলের শোকে এখনো কাতর বিলকিস জামান বলেন, ‘আমার ছেলে ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে বাইরে গেল সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। সেদিন আমি ব্যস্ত ছিলাম। ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই খাবার খেয়েছে। চেয়ারে বসে ভাবছিলাম টেবিলে এঁটো প্লেট-বাটি এলোমেলো হয়ে আছে। এগুলো গুছিয়ে নিই। এই ভেবে দরজা পর্যন্ত গেলাম না। তানভীন এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে দরজার সামনে এগিয়ে সালাম দিয়ে বের হয়ে গেল। অন্যদিনের মতো বিদায় জানানো হয়নি তাকে। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। প্রতিদিন তার সালামের উত্তর দিয়ে তিন কুল (সুরা) পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতাম।’

তানভীনের ছোটবেলা থেকে এ রকমই হয়ে আসছিল। দীর্ঘদিনের এই চর্চার ব্যত্যয় ঘটে গেল কেবল ১৮ জুলাই। সালাম দেওয়ার পর সালামের উত্তর দেন মা। এতটুকু ছেলের সঙ্গে এটা ছিল তার শেষ কথা। এ যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে, তা বোঝেননি মা।

আমার সব শেষ হয়ে গেছে বলেই মা বিলকিস বলেন, ‘আমি তখন বাসায় ছিলাম। ওর মোবাইল দিয়ে কেউ একজন আমাকে কল করে বলল, আপনার ছেলে গুলি খাইছে। হাসপাতালে আসেন। তা শুনে আমি অতি দ্রুত উত্তরায় কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে যাই।’

আরও পড়ুন: ‘আপনাদের তালা আমি ভেঙে দেব, তবে আমাদের বাঁচাতে হবে’

তানভীন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ২০২২ সালে তিনি স্নাতক শেষ করেন। পরে তিনি তার তিন বন্ধুকে নিয়ে তাদের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে দেশের প্রথম এবং একমাত্র ড্রোন বিক্রি, বাণিজ্যিক আবেদন এবং সেবাসমূহের ‘অ্যান্টস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি জরিপের নানা ধরনের কাজ করার পাশাপাশি অনলাইনে ড্রোন বিক্রিও করতো। তানভীন এই প্রতিষ্ঠানে ‘চিফ টেকনিক্যাল অফিসার’ হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

২০১৮ সালে বুয়েট নেভাল ডিপার্টমেন্টের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেস্ট শিফট ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় তার দল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের প্রতিযোগিতাতেও দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে। একাধারে ২০২০ ও ২১ সালে আননেমড এরিয়াল প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করে তানভীন ও তার দল।

আরও পড়ুন: ‘মাথা-বুক রক্তে ভিজে যায়, বাঁ চোখ চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’

এ ছাড়া বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএএসএ- নাসা) আয়োজিত ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় তানভীন ও তার গ্রুপ বিশ্বের দশম এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। পরবর্তীতে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিক্যাল, মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের  শিক্ষার্থী থাকাকালীন তানভীন বুয়েট আয়োজিত  ‘মডেল শিপ প্রপালশান কম্পিটিশন’-এ অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর দেশের গণ্ডি পার হয়ে তিনি ও তার দল যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আয়োজিত ইউএএস এয়ারক্রাফট সিস্টেম কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। এ প্রতিযোগিতায় ছয়টি পুরস্কারের মধ্যে তিনটিই লাভ করেন তানভীন ও তার দল।

তানভীনের মা বলেন, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি গভীর মনোযোগ ছিল তার। প্রযুক্তিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। মেধাবী ছিল আমার তানভীন। সে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ড্রোন নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। আইসিটি ডিভিশনের অধীনে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ড প্রতিযোগিতায় জিতে অনুদান পাওয়া ১০ লাখ টাকা দিয়ে ড্রোন বানানোর প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্টস’ নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে।

আমার ছেলে অনেক বিনয়ী ও ভদ্র ছিল। সে ড্রোন বানিয়ে নিজে বিক্রি করতো। নানা ধরনের পুরস্কার পেয়েছে। দেশের বাইরে যেতে চায়নি।  দেশে ও দেশের বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সফল হতে চেয়েছিল। ওর আব্বু ওকে বিসিএস পরীক্ষা দিতে বলছিল। তানভীন বলেছিল, ‘মা, আমি ব্যবসা করব। কোনো দিনই সরকারি চাকরি করবো না। তাহলে কেন বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবো?’

আরও পড়ুন: ছাত্র আন্দোলনে নিহত হৃদয় তরুয়ার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন পবিপ্রবি

জাহিদুজ্জামান এর মামা সমকালের টঙ্গী প্রতিনিধি আবু সালেহ মূসা বাবু বলেন, ১৮ জুলাই আমি আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমার মেজ বোন তানভীনের মা আমাকে মোবাইলে ফোন করে বললেন, ‘বাবু, কোটা সংস্কার আন্দোলনের জায়গা থেকে তোর ভাগিনার শরীরে গুলি লাগছে। তার অবস্থা তো ভালো না।’ এই কথা শুনে আমি টঙ্গী থেকে উত্তরার দিকে রওনা দিই। আব্দুল্লাহপুরে আসার পরপরই আপা আবার ফোন করে আহাজারি করে জানান, ‘বাবুরে, তোর ভাগিনা তো আর নাই।’ পরে জানতে পারি কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে আমাদের সবার প্রিয়, আমাদের দুই পরিবারের বংশের বড় ছেলে তানভীনের মরদেহ পড়ে আছে।

তিনি বলেন, আমি বহু বাধাবিপত্তি পার হয়ে হাসপাতালে পৌঁছাই। গিয়ে দেখি হাসপাতালের বাথরুমে (তাৎক্ষণিকভাবে ডোম ঘর বানানো) তানভীন ছাড়া আরও চারটি লাশ পড়ে  আছে। মরদেহ আনতে গিয়ে পুলিশ ও হাসপাতালের ডাক্তারদের বাধার মুখে পড়ি। অনেক বাগবিতণ্ডার পর তার মরদেহ উদ্ধার করি বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে। পরে তাকে নিয়ে আজমপুরে তাদের ভাড়া বাসায় এসে প্রথম জানাজা দেওয়ার পর তার মরদেহ ব্রাহ্মণবাাড়িয়ায় তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। আনুমানিক রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

তিনি বলেন, আমার ভাগ্নে ছোটবেলায় আমাদের কাছে পড়াশোনা করেছে। সে টঙ্গী থেকে এসএসসি এবং রাজশাহী থেকে এইচএইচসি পাস করে গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর আগে।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি দেখে বেরিয়ে পড়েন রিকশাচালক ইসমাইল, ফিরলেন লাশ হয়ে

তার বাবা শামসুজ্জামান (৫২) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং তার একমাত্র বোনও বিএসসি  ইঞ্জিনিয়ার। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে। আমাদের মামা-ভাগিনার সম্পর্ক ছিল মধুর। বাসা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে থাকা বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে।

এ্যান্টসের নির্বাহী কর্মকর্তা ও বন্ধু তাওসিফুল ইসলাম তওসিফ বলেন, তানভিন এ্যান্টসের টেকনিক্যাল সাইডটা দেখত। আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটা করা। খুবই ট্যালেন্টেড ইঞ্জিনিয়ার ছিল সে। অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। মৃত্যুর আগের দিন ১৭ জুলাই রাত ১০টা পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ১৮ জুলাই যেদিন ও চলে গেল, সেদিনও কিছু ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা ছিল। পরে রাতে যখন শুনতে পাই দেশের সিচুয়েশন খুব খারাপ হয়ে গেছে, তখন তা ক্যানসেল করে সিদ্ধান্ত নিই যে কালকে (১৮ জুলাই) কেউ অফিসে আসবো না। পরদিন বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে জীবনটা দিয়ে দিল।

তাওসিফ আরও বলেন, ড্রোনের সম্প্রসারণ নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল। তানভীনকে ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান হয়তো কখনোই দাঁড়াতো না।  অ্যান্টস বর্তমানে ড্রোনের পাইলটিং ও ম্যাপিং নিয়ে কাজ করে। অ্যান্টস বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি, কৃষি অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। তানভীন তার সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে গেলো। তানভীন চলে যাওয়ায় এ খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

তানভিন মারা যাওয়ার পর তাই তার এলাকার গোল চত্বর পাঁচ মাথার মোড় গোদাগাড়ীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘শহিদ তানভীন চত্বর’। আগে এই চত্বরের নাম ছিল ফিরোজ গোল চত্বর। এখন সেখানে দুটি গাছও লাগানো হয়েছে।

সূত্র: বাসস


সর্বশেষ সংবাদ