বাউলশিল্পী আবুল সরকার গ্রেপ্তার, আসলে কী ঘটেছিল?
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬ PM , আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬ PM
বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবুল সরকারের বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে তিনি ‘ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের অবমাননা করে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কটূক্তি করে অবমাননামূলক অট্টহাসি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে উসকানি দেয়ার অপরাধ’ করেছেন।
যদিও তার ভক্ত-শিষ্যদের দাবি পালাগানের নির্দিষ্ট একটি অংশ কেটে বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মাজার ভাঙা, গানের আয়োজন বন্ধ করাসহ সাধনার ধারার সাথে যুক্ত শিল্পীদের বিরুদ্ধে ঘটা এসব ঘটনা কোনোভাবেই ‘গ্রহণযোগ্য না’।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার থাকাকালীন শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের দমন-পীড়নের যে চর্চা দেখা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও সেই ধারাবাহিকতা চলমান আছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
আবুল সরকারের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় একটি পালাগানের আসরে সংগীত পরিবেশন করেন আবুল সরকার। সেই পরিবেশনার কিছু অংশের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে তিনি ‘মহান আল্লাহ তায়ালাকে নিয়ে অশালীন কটূক্তি’ করেন বলে অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করেছে এলাকার আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা।
আবুল সরকারের ভক্ত ও শিষ্য রাজু সরকার বলেন, বুধবার রাত একটার দিকে মাদারীপুরের একটি গানের আসর থেকে ‘নিরাপত্তার কথা বলে’ রাজৈর থানার পুলিশ আবুল সরকারকে নিয়ে যায়।
পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে আবুল সরকারের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানিকগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজস্ট্রেটের আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তাওহিদী জনতা’। এ সময় সেখানে উপস্থিত কয়েকজনের হাতে ‘আবুল বয়াতির ফাঁসি চাই’ লেখা কাগজও ধরে থাকতে দেখা যায়।
পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আবুল সরকারের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননা, কটূক্তি ও দাঙ্গা উসকে দেয়ার’ অভিযোগে মামলা করে ঘিওর বন্দর মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল্লাহ। সন্ধ্যায় আবুল সরকারকে মানিকগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তবে রাজু সরকারের দাবি, পালাগানের পুরোটা প্রচার না করে এর নির্দিষ্ট একটি অংশ কেটে বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নেতিবাচকভাবে তা প্রচার করা হচ্ছে। পালা শুরুর আগেই কোনো ভুলভ্রান্তি হলে তার জন্য সবার কাছে মাফ চেয়ে নেয়া হলেও, ‘ব্যাপারটাকে ঘোলাটে করে ওনার (আবুল সরকার) প্রতি কাঁদা ছোড়াছোড়ি শুরু করেছে কথিত কিছু আলেম সম্প্রদায়,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির একটি অংশ পালাগান ও বিচারগান। সঙ্গীতের এই ধারার চর্চা করেন আবুল সরকার। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট একটি বিষয় অবলম্বনে দুটি পক্ষের কথা ও সুরসহযোগে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয় বিচার গান, যা বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি বড় অংশ।
‘বিচার গানের বিষয় প্রধানত শরিয়ত, মারিফত, নবীতত্ত্ব, আদমতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, নারীতত্ত্ব, যৌবনতত্ত্ব প্রভৃতি। এছাড়া নারী-পুরুষ, গুরু-শিষ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়েও এ গানের প্রতিযোগিতা হয়’।
দার্শনিক ও সমাজ বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার জানান, পালাগানে নাটকীয়ভাবে একটি বিষয়কে তুলে ধরা হয়। ‘তার মধ্য দিয়েই জনগণ আনন্দ পায়, ধর্মতত্ত্বের অভ্যন্তরে যে দার্শনিক ব্যাপারটা থাকে এটাকে তারা পর্যালোচনা ও ক্রিটিক্যাল সমালোচনার মধ্য দিয়ে সামনে তুলে আনে। এটাই এই গানের বৈশিষ্ট্য।’ বলেন তিনি।
কিন্তু এই ঘটনায় কেবল একটি পক্ষের বক্তব্যের প্রচার আর তার পরিপ্রেক্ষিতে আবুল সরকারের গ্রেফতারকে করার ঘটনাকে ‘অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত কাজ’ বলে মন্তব্য করেন এই সমাজ বিশ্লেষক।
‘সরকারকে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা মাজারের বিরুদ্ধে, এখানকার শিল্পী–যারা বাংলার সাধনার ধারার সাথে যুক্ত তাদেরকে অত্যাচারিত করছে। ফলে এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য না,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। দেশের বাইরেও এই ঘটনা সরকারের ‘নিকৃষ্ট ভাবমূর্তি’ তৈরি করবে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
‘ধর্ম অবমাননা মধ্যযুগীয় ধারণা’
আবুল সরকারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৫৩, ২৯৫-এ এবং ২৯৮ ধারার মামলা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা সহিংসতা সৃষ্টি করতে প্ররোচনা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনা হয়েছে, যার সবগুলোর শাস্তিই দুই বছরের কম।
আইনের আরেকটি ধারা অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে অর্থাৎ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তি আছে এমন কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত চাইলে ভর্ৎসনা করে অভিযুক্তকে ছেড়ে দিতে পারেন বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
এমনকি ১৮৬০ সালের মূল যে ফৌজদারি আইন তাতে ধর্মীয় অবমাননার কোনো ধারা ছিল না বলেও জানান তিনি। পরবর্তী সময়ে একটি দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে ১৯২৫ আইন সংশোধন করে এটি যুক্ত করা হয়।
আর ধর্ম অবমাননার বিষয়টিকে মধ্যযুগীয় ধারণা বলেই মনে করেন শাহদীন মালিক। ‘একজনের সাথে আরেকজনের ধর্মতো মিলবে না। একদিকে আমরা সম্প্রীতির কথা বলছি, আবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কথা বলছি। এটা পরস্পরবিরোধী,’ বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদের শেষদিকে অনেক শিল্পীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনে মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছিল, যার কারণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। গণঅভ্যুত্থানের পর সেই পরিবেশের একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হবার কথা ভেবেছিলেন অনেকেই।
কিন্তু তার পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গানের আয়োজন বন্ধ, দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙা এমনকি কবর থেকে লাশ তুলে পোড়ানোর ঘটনাও দেখে গেছে। শাহদীন মালিকের মতে, জুলাই আন্দোলনের পরিবর্তনের পর গণতান্ত্রিক উদারমনা হবার পরিবর্তে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে, যা গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি।
‘এই যে মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি চাওয়া বা একেকটা মামলায় দুই তিনশো লোককে আসামি করা, এটা জুলাই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা ছিল আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটছি’। এই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক বলেও মনে করেন তিনি।
এই ধরনের ঘটনায় নিজের উদাহরণ টেনে ফরহাদ মজহার বলেন, প্রকাশ্যে তাকে ‘কতল’ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ‘ফরহাদ মজহারকে কতল না করে ইসলাম কায়েম হবে না’। অথচ এমন আহ্বান জানানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ‘তার মানে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার উভয়ের মধ্যেই এদের অপরাধকে উপেক্ষা করার একটা টেন্ডেন্সি (প্রবণতা) আমরা দেখেছি,’ বলেন তিনি।
তার মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বর্তমান সরকার এই ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সমাজের মধ্যে আওয়ামী লীগের আমলেই যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেটা নিরাময় করতে তারা ‘চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে’।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা