প্রাইমারি স্কুল
- ড. আসিফ নজরুল
- প্রকাশ: ০৬ মে ২০২২, ১১:৪৬ AM , আপডেট: ০৬ মে ২০২২, ১১:৪৬ AM
প্রথম স্কুলের নাম মনে নেই আমার। সেখানে পড়েছিলাম মাত্র কয়েকদিন। আরিচা রোডের একপারে স্কুল, অন্যপারে সাভার রেডিও কলোনি। কলোনি থেকে স্কুলে যাই পায়ে হেঁটে। দু’বছরের বড় বোনের সঙ্গে। সেও ক্লাস-টুতে, আমিও। রুগ্ন শরীর, বিব্রত চেহারা, মলিন কাপড়, খুবই অনুল্লেখ্য ছিল আমার বেশভুষা।
স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন রাস্তায় দেখি দৈত্য সাইজের ঘোড়া যাচ্ছে ঘাড় দুলাতে দুলাতে। ভয়ে সিটিয়ে নেমে যাই নিচের খাদে। আরেকদিন হুস হুস করে চলা বাস দেখে আঁকড়ে ধরি বোনের হাত। প্রথম স্কুলের বাকি স্মৃতি হচ্ছে রিলিফের ছাতু খাওয়ার।
দেশটা মাত্র স্বাধীন হয়েছে তখন। বাদামি রঙ্গের বড় বড় বস্তা খুলে স্কুলে অকাতরে বিলানো হতো ছাতু। পত্রিকা ছেঁড়া কাগজে উঁচু করে ভরে সেই ছাতু খেতাম। খেতে তা খুব ভালো ছিল না, কিন্তু তবু খেতাম অনেক।
আমরা ছিলাম দরিদ্র একটা সময়ের শিশু। মানুষের হাতে টাকা ছিল না তখন, বাজারে জিনিসও ছিল খুব কম। স্কুলে টিফিন ছিল না, স্কুলের সামনে বা আশেপাশে খাবার বিক্রির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবস্থা থাকলেও লাভ হতো না, কারণ শিশুদের হাতে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া হতো না তখন। কিংবা তাদের হাতে টাকা ছিল না বলেই হয়তো আচার, ফরমুল বা বিস্কিট বিক্রি করা ধরনের কোনো ফেরিওয়ালাও ছিল না তখন।
ক্ষুধার্ত অবস্থায় রিলিফের ছাতুই তাই অমৃত মনে হতো। গোগ্রাসে খেতাম তা, খেতে খেতে বুক ফেটে যেত তৃষ্ণায়। ছাতু খেয়েই কিনা জানি না, একদিন বাথরুমের (মানে টয়লেটের) প্রয়োজন হলো আমার। কিন্তু স্কুলে কোনো টয়লেট নেই। পেটের মোচড়ে কাঁদতে শুরু করলাম। বড় ক্লাসের একজন সাত সমুদ্র তের নদী পার করে আমাকে নিয়ে গেল গ্রামের কাঁচা বাথরুমে।
প্রথম স্কুলের আর কোনো স্মৃতি নেই আমার। কারণ সেখানে থেকেছি অল্পদিন। একদিন আব্বা দাঁড়িয়ে ছিলেন কলোনির দোতলা বাসার বারান্দায়। কলোনিতে বিল্ডিং তখন মাত্র ছয়টা। চারপাশ বন জঙ্গল, একপাশে বিরাট পুকুর। সেই পুকুরের পাড়ে সামান্য জংলা জায়গায় একটা জলপাই গাছ, তার ঠিক পাশে কলোনির প্রাচীর। প্রাচীরের অন্যপারে আরিচা রোড। তখন বায়ু ছিল নির্মল, মানুষের দৃষ্টি ছিল স্পষ্ট।
আব্বা তাই এতদূর থেকেই দেখলেন, আরিচা রোডের তুলো গাছের নিচ দিয়ে ‘মাটির সঙ্গে লেগে লেগে’ আসছে তার দু’সন্তান। একটু পর পর দানবাকৃতির বাসের আড়ালে চলে যাচ্ছে তাদের সামান্য অবয়ব। তিনি ভয় পেলেন। স্কুলে যাওয়া বাদ হলো আমাদের।
ভয় পাওয়া অফিসার আরও ছিল কলোনিতে। তারা একে-তাকে ধরে একদিন কলোনির ভেতরেই স্কুলের ব্যবস্থা করলেন। সাভার ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। ক্লাস ওয়ান-টু নেই সেখানে। কাজেই ভর্তি হলাম ক্লাস থ্রি-তে। মাটির মেঝে, টিনের চাল-ছাদ। জানালার মতো কিছু একটা ছিল সেখানে, বৃষ্টি এলে কিছুটা ঠেকানো যেত তা বন্ধ করা গেলে।
আরও পড়ুন: মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা: অর্জন, প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়
ক্লাসের ভেতর গোটা কয়েক বেঞ্চ, ব্লাকবোর্ড, তার সামনে শিক্ষকের হেলে পড়া চেয়ার। ক্লাসের ভেতর রোদের দিনে ছায়া, বৃষ্টির দিনে অন্ধকার। বড় ছুটির পর ক্লাসে আসলে দেখা যেত ছাগলের লাদিতে ভরে আছে তা।
আমার ক্লাসের শিক্ষকদের একজন আসেন পাশের মিলিটারী ফার্ম থেকে। ছোট করে ছাঁটা চুলের, তিনি মজিদ স্যার। আমার গ্রামের চাচার মতো কুচকুচে কালো মুখ আর তেলমাখা চুলের ফিরোজ স্যার। চাঁদি ছিলা মুরগির মতো রাগী তৈয়ব স্যার। আর একজন ইসলামিয়াত স্যার। আমার ক্লাসে পড়ে মাথায় ওড়না দেয়া মেহেরন্নিকা (আসলে হয়তো মেগের নিগার)। ইসলামিয়াত স্যার সারাক্ষণ প্রশ্ন করেন তাকে। মেহেরন্নিকা উত্তর না দিয়ে মাথার ঘোমটায় মুখ লুকোয়।
আমি নজরুল, আমার ক্লাসে পড়ে আরেক নজরুল। করুণ চেহারার লিকলিকে মরিয়মের ছোট ভাই সে। আর আছে আমার বোন। মোট ছাত্র পাঁচজন। ক্লাসে পড়ায় মন নেই আমার। টিনের ছাদে বৃষ্টির তুমুল বাদ্য, জানলার পাশে কাঁঠাল পাতায় উছলে ওঠা ফোঁটা আর স্কুলের মাঠে ঘোর লাগানো অবিরাম বর্ষণ- স্কুলের সবচেয়ে নিবিড় স্মৃতি এটাই।
স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার আধাপথ ইটের খোয়ার। সেই বৃষ্টিতে তা ডুবে যায়, হাঁটু পানিতে হাতড়ে হাতড়ে মাছ খুঁজি, ব্যাঙ আর কেঁচো দেখি, সাপের ভয়ে সতর্ক থাকি। পথে একদিকে উদার প্রসারিত পেয়ারা গাছে উঠি। তখনই জানি পেয়ারার ডাল শক্ত, সজনের খুব নরম। শক্ত ডালে বসে পাশের আনারস ঝোপ দেখি আতিপাতি করে। সেখানেই নাকি লটকে থাকে সাপ। তারপাশে ডেওয়া গাছ! ভর দুপুরে সেই গাছে ঢিল মেরে সাপের তাড়া খেয়েছিল দারোয়ান আনোয়ার। বাঁচলো কীভাবে? এঁকেবেঁকে দৌড়ে।
এঁকেবেঁকে দৌড়ের প্র্যাকটিস করতাম আমরাও। সেই দৌড়ে সেরা ছিল মাহমুদ। চিকন, তেল চিটচিটে পিছলা শরীর, চেহারা দেখলেই মনে হতো কিছু একটা করে এখনই দৌড়ে পালাবে সে। সে থাকে রেডিও কলোনির সীমানাঘেঁষা গ্রামে। সেখানে থাকে গোলগাল চেহারার আমিরও। তার বাড়ির খেজুরগাছের নিচে জিহ্বা বড় করে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা কয়েকজন। আমি, শ্যামল, নব্বীর, সমীর, রিপন। রস পড়েছিল আমার গালে। কি দুঃখই না পেয়েছিলাম সেদিন।
বাড়ির পথে খোয়ার পথ, পেয়ারা গাছ আর আনারস ঝোপ শেষ হলো দু’পাশে ধানক্ষেত। তারপর কলোনির রাস্তা। সেই রাস্তার উঠলে ডানদিকে কিছুদুর গেলে কলোনির দু’পাট প্রবেশদ্বার। সেখানে না গিয়ে সোজা গেলে কলোনির ভবন। সিরিয়াল ধরে দুটো বিল্ডিং, সেগুলোর পাশে আরও দুটো বিল্ডিং। রাস্তার অন্যপাশ অর্ধেকটা বিশাল মাঠ। আর অর্ধেকে আরও দুটো বিল্ডিং।
সাকুল্যে ছয়টা মাত্র বিল্ডিং অফিসারদের, আর কলোনির শেষপ্রান্তে দুটো কর্মচারীদের। বাকি বিশাল জায়গা মাঠ, ধানক্ষেত, প্রবেশদ্বারের পাশে বড় পুকুর, পুকুরের চারপাশ ঘিরে ঘন বন। সেই বনে বাঁশঝাড়, খরগোস, গুইসাপ, উইপোকার ডিবি, তেতই, বেতফল আর টিপাফল।
সারা কলোনিজুড়ে অকাতরে বেড়ে ওঠা কাঁঠাল, আম, কলা আর নাম না জানা বুনো গাছ। তার ফাঁকে ফাঁকে শিমুল তুলো, বট আর অশ্বত্থ।
সেই বনে, সেই মাঠে, সেই পুকুরে সারাটা দিন কাটতো আমাদের। স্কুলের সময়টা মাঝে মাঝে মনে হতো জেলখানার মতো। এক পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলে আরেকটার অপেক্ষা করি। চারটা ঘণ্টা হলে এক দৌড়ে মাঠে। তবু এ স্কুলে শিখি কতকিছু। নামতা, প্রেজেন্ট কন্টিনিওয়াস টেন্স, সন্ধি বিচ্ছেদ, মানসাঙ্ক।
পড়া না পারলে তৈয়ব স্যারের বেতের বাড়িতে হাত জ্বলে যেত। ঘুমে ডিস্টার্ব হলে ফিরোজ স্যার হঠাৎ ছুড়ে মারতেন ডাস্টার। চুজ-এর পাস্ট পার্টিসিপল চোজেন বলতে পারলে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন মজিদ স্যার। দুরু দুরু বক্ষে হাফ ইয়ার্লির রেজাল্ট-এর অপেক্ষা, আরও আতঙ্কে ফাইনালের। প্রতিবার কেমন করে যেন আমিই ফার্স্ট। তবু ভয়ে ভয়ে ফিরতাম বাসায়। মেয়েদের কিছু বলতেন না। কিন্তু ছেলেরা খারাপ করলে মেরে হাড্ডি গুঁড়া করে দিতেন আব্বা।
সেই স্কুল থেকেই ক্লাস ফাইভ পাস করি। তারপর আমরা চলে আসি ঢাকায়। চলে আসার সময় একটুও কাঁদি না। কিন্তু যত দিন যায় সেই কান্না বাড়ে। এখনো এই মধ্য বয়সে সাভারের কাছাকাছি কোথাও গেলে কলোনিতে ঢুকি। ঘিঞ্জি বিল্ডিং আর লোকে লোকারণ্য কলোনির হঠাৎ একটা ঝোপ বা একটা গাছ রয়ে গেছে আগের মতো।
স্কুলের সবও বদলে গেছে। কিন্তু সামনের মাঠটা আছে, আছে পেছনের স্মৃতি। স্কুলের বাচ্চাদের ডেকে ডেকে বলি, আমি পড়তাম এই স্কুলে। অবাক হয়ে তাকায় তারা। কেমন করে তারা বুঝবে বয়স্ক এ হৃদয়ের কতো গভীরে থাকে প্রাইমারি স্কুল!
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়