জীবিত ইমামদের চেয়ে মৃত ইমামরা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?

  © ফাইল ফটো

আত্মহত্যা করে সেলিব্রেটি বনে যাওয়া ঢাবির ছাত্র ইমাম হোসেনের প্রোফাইল ঘুরে এলাম।

বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর আর কেউ ‘আল-বিদা ’ লিখে পোস্ট দিয়ে ২১ হাজার লাইক পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। একটা পোস্ট “একুশ হাজার লাইক, দশ হাজার কমেন্ট, পাঁচ হাজার শেয়ার” এমনটা আত্মহত্যার এক মিনিট আগে দেখলে আমি হলফ করে বলতে পারি এই ছেলে আত্মহত্যা করতো না। সিগারেট ধরিয়ে কমেন্টের রিপ্লাই দিতে শুরু করতো। এই আমি, আপনি বা আমাদের কাছে জীবিত ইমাম হোসেনদের চেয়ে মৃত ইমাম হোসেনরা কেন এত গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে?

ইমাম হোসেন আত্মহত্যা করেছেন প্রেমজনিত কারণে। একটা মেয়েকে ভালোবেসে তাকে মোটিভেট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পাইয়ে দিয়েছে। তারপর সেই মেয়েটা অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আরে ভাই, তুমি একটা মেয়েকে মোটিভেট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়াতে পারো, আর নিজেকে একটু মোটিভেট করে বেঁচে থাকতো পারো না? তুমি কেমন মোটিভেটর?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা চান্স পায়? কিভাবে পায়? আর দশটা সাধারণ ছাত্র রাতে ভাত খেয়ে ব্রাশ করে ফেসবুক চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে দেখে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেছে? না। তাকে শত শত রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়। টেবিলের সাথে, বইয়ের সাথে লেপটে থাকতে হয়। বিসর্জন দিতে হয় প্রিয় বন্ধুদের সাথে ধুন্ধমার আড্ডা, মামাতো বোনের বউভাত, প্রিয় ভাগ্নে-ভাগ্নির জন্মদিন। এত পরিশ্রম করে, এত বিসর্জন দিয়ে তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে কিসের জন্য? প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্য?

যারা দিন রাত পড়াশুনা করে সবাই কি চান্স পায় ঢাবিতে? পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যও তো লাগে। খোঁজ নিয়ে দেখো কত মেধাবী ঢাবিতে পরীক্ষাই দিতে পারেনি।
তুমি মেধাবী, তুমি পরিশ্রমী, তুমি ভাগ্যবান। তারপরও তুমি আত্মঘাতী। কেন ভাই? তোমার চেয়ে কম পেয়ে, তোমার চেয়ে বেশি হারিয়ে মানুষ বেঁচে আছে না? বাংলার ইতিহাসে তুমিই কি প্রথম ভালোবাসার বিনিময়ে প্রতারণা পেয়েছো? তোমার জীবন এতই তুচ্ছ?

এমন না যে ইমাম হোসেন প্রথম এবং ইমাম হোসেনই শেষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটে। কিছুদিন ফেসবুকে হৈচৈ চলতে থাকে। তারপর সব থেমে যায়। প্রস্তুতি নিতে থাকে আরেক ইমাম হোসেন।

আত্মহত্যা যে কেবল ভার্সিটিগুলোতেই হয়ে থাকে তাও না। গ্রাম থেকে শহর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শোবিজ, সব জায়গায়ই হয়। তারপরও তারকাদের আত্মহত্যার পর সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যাগুলো। কারণ ধরে নেওয়া হয় তারা সমাজের মেধাবী ও সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত নাগরিক। রাষ্ট্র তাদের পেছনে টাকা খরচ করছে। তারা দেশকে, সমাজকে এবং পরিবারকে কিছু একটা দিবে সেই প্রত্যাশা থাকে সবার। অথচ তারা প্রেমিক/প্রেমিকার জন্য জীবন দেয়।

গ্রামের কিছু গৃহবধূ আছেন, যাদের স্বামী জুয়া খেলে, গাঁজা খায় আর সকাল বিকাল স্ত্রীকে মারধর করে। ঘরে রান্নার মতো, সন্তানের মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাবার থাকে না। সারাদিন জুয়া খেলে এসে খাবার না পেয়ে স্বামী মারধর করে স্ত্রীকে। স্বামীর নির্যাতন, সন্তানের জন্য অসহায়ত্ব আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ থেকে মুক্তির একটাই পথ থাকে তাদের। কিন্তু ইমাম হোসেনদের সামনে কি একটা পথই খোলা ছিল? তাদের ভবিষ্যৎ কি এতই অন্ধকার ছিল?

ইমাম হোসেনের ফেসবুক বায়োতে লেখা, আম্মু ও হাবিবার সেবক। এখন তোমার আম্মু কোথায় ইমাম হোসেন? কে তাকে সেবা করবে? স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো স্থায়ী, বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তোমার আম্মুর কথা মনে পড়ে নাই?

তুমি মিয়া যেই শরীরকে ঝুলিয়ে দিলে রশিতে সেই শরীর বাঁচানোর জন্য তোমার মা এক রাতে পাঁচ-সাতবার ঘুম থেকে উঠে তোমার ভেজা কাপর বদলে দিয়েছে। সেই মাকে দিলে ভেজা চোখ। যতদিন তোমার মা বাঁচবেন, তোমাকে ভুলতে পারবেন? তুমি বেছে নিলে অভিশপ্ত আখেরাত। মাকে দিলে অভিশপ্ত জীবন।

যে ফেসবুকে পোস্ট দিতে পারে- ‘‘ইনশাআল্লাহ ‘একদিন আব্বু-আম্মু আর সাথে তোমায় নিয়ে আমিও পবিত্র মক্কা ভূমিতে গিয়ে হজ্ব পালন করে আসবো।’’

সেই করে আত্মহত্যা। নিজের সাথে এরচেয়ে বড় হঠকারিতা আর কী হয়?

ইমাম হোসেন চলে গেছেন। তাকে ফেরত আনা যাবে না। কিন্তু আগামীতে কেউ যেন ইমাম হোসেন না হয় সেই চেষ্টা আমরা করতে পারি। যেই মানুষটা এই মুহূর্তে আত্মহত্যার কথা ভাবছেন তার উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন- প্রেমিক/প্রেমিকার জন্য জীবন নাকি জীবনের জন্য প্রেমিক/প্রেমিকা? জীবন না অর্জন, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তোমার কাছে যদি বাপ মায়ের ভালোবাসা, ভাই-বোনের আদর স্নেহ, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গের চেয়ে অভিশপ্ত মৃত্যুই বেশি আপন মনে হয়, তোমার আসলে অনেক আগেই মরে যাওয়া উচিত ছিল।

লেখা: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত


সর্বশেষ সংবাদ