করোনায় কমেছে দূষণ, নতুন রূপে সেজেছে প্রকৃতি

  © ফাইল ফটো

কোভিড ১৯ নভেল করোনা ভাইরাস এ যেন এক আতংকের নাম।ভাইরাসটি অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে হওয়ায় পৃথিবীর সবাইকে অস্থির করে দিয়েছে। পৃথিবী আজ থমকে গেছে,থমকে গেছে কুড়িগ্রাম জেলার মঙ্গা পীড়িত একটি ছোট্ট গ্রাম মোগলবাসা-আমার বাড়ি এই গ্রামেই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পরে ভেবেছিলাম ছুটি শেষ হলেই সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়ে হবে। পরীক্ষার রুটিনও দিয়ে দিয়েছিল। তাই বেশ কয়েকদিন মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে কাটিয়েছি।

যখন ছুটি বাড়ানো হল তখন ভাবলাম আর হয়ত বাড়ানো হবে না, পরিস্থিতি খুব একটা খারাপের দিকেও এগোবে না দেশ।তবে বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি দেখে বেশ ভয় পেয়েছি, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। আরো কিছু দিন পড়াশোনা করার পর নিজের মধ্যে ধৈর্য্য আটকে রাখতে পারলাম না। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দিন-রাত অবসর সময় কাটাতে শরু করলাম। কখনও সিনেমা, কখনও গল্পের বই, কখনও পছন্দের রান্না করে পরিবারের সবাইকে তাক লাগানো, মা কে কাজে সাহায্য করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো,বাড়ির ছোট্ট বাচ্চাদের রোজ বই পড়ানো, তাদের গল্প শোনানো, তাদের সাথে খেলাধুলা করা।

প্রতিবেশী এক অসুস্থ দাদীর সেবা যত্ন করেছি। রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা,কুরআন তেলওয়াত করা ইত্যাদি করেই দিন গুলো কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার নজরে এল আমার গ্রামের অসহায় মানুষ গুলো।এই গ্রামের বেশি ভাগ মানুষ দিন আনে,দিন খায়। করোনার এই দিনে তাদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। আমার পাশের বাড়ির জমির উদ্দিনের কথাই বলি।পেশায় একজন দিন- মজুর।স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ের কষ্টের সংসার তার।বড় ছেলে ঢাকার গার্মেন্টস শ্রমিক। লকডাউনের বেড়াজালে বাঁধা পরেছে।

তাদের প্রাত্যহিক জীবন। চারদিক ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজে বেড়ানো সম্ভব হচ্ছে না জমির উদ্দীন মুন্সির। আর ছেলের ও মাসিক মাইনে বন্ধ ঢাকা শহরের রেড জোনে আটকে পড়েছে সে। এই সংকটাপন্নে পরিবারের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে না পেরে যখন কান্নায় ভেঙে পড়ছে, জমির মুন্সি। সেই সময় আমরা এলাকার কয়েকজন তরুণ- তরুণী উদ্যোগ নিয়েছি তাদের পাশে দাঁড়ানোর। স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোজ বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা আদায় করা,বাজার করা, রান্না করে দরিদ্রের মাঝে বিতরন করছি। এ কাজটি করতে আমরা নিজেরাও হিমসিম খাচ্ছি,কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র,আবার বিতরন করতে গিয়ে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা খুবই কঠিন। তাই প্রতিনিয়ত থাকছে নিজেরই করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি।

এলাকার বন্ধুরা মিলে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য লিফলেট তৈরি করছি তাতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বানী-সামাজিক দুরত্ব ৩ মিটার বজায় রাখুন, মাস্ক ব্যাবহার করুণ, সাবান দিয়ে ভালভাবে ২০ সেকেন্ড হাত ধৌত করুন। প্রথম দিকে এলাকাবাসী আমাদের উপর বিরক্ত হতো তাদের চোখেমুখে অসন্তোষের ছাপ দেখতে পেতাম কিন্তু আসতে আসতে তারাও বুঝতে পারছে এবং সচেতনতা বাড়ছে। আমাদের মধ্যেও আগ্রহ বাড়ছে মানুষকে সাহায্য করার। বড়দের সহযোগিতায় এলাকার মোড়ে মোড়ে সাবান পানি দিয়ে আমরা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি, গ্রামবাসীরা তা সানন্দে ব্যবহার করছে। করোনা থেকে বাচবো নিমিত্তে সবাই মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে, ফলে পানি বায়ুবাহিত ও অন্যান্য রোগ নেই বললেই চলে।

যেখানে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞানী, গবেষকরা টিকা আবিষ্কার করতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন সেখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কি’বা প্রত্যাশা করা যায়। ৬ মাসের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস পৃথিবী জুড়ে বিস্তার লাভ করলেও এখনো কোন প্রতিষেধক না সাধারণ মানুষদের মনে ভয় বেড়েছে। সেকারনে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এসেছে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো সাধ্যনেই এই বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করতে পারে। বলতে গেলে করোনায় সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্ম ভীরুতা বেড়েছে।

গৃহ শিক্ষক আর জিপিএ-৫ এর যুগে একাডেমিক পড়াশোনা ছাড়া শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা কিংবা বাইরের বই পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না।কিন্তু; করোনার কারনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের এখন প্রচুর সময় পাচ্ছে। ফলে এই সময়ে অনেকেই গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস সংবলিত বই পড়ে সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে । অন্যদিকে যারা চাকরির কারনে বছরের পর বছর বাইরে অবস্থান করতো তারাও শহর থেকে গ্রামে চলে এসেছে। এতে পরিবারকে সময় দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে পারস্পারিক ভালোবাসা আর সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্কগুলো আরো শক্ত ও মজবুত হয়ে উঠছে।

শিকড়ের টানে গ্রামে ছুটে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, শহুরে জীবন শুধুই মেকি! প্রকৃতি ও প্রশান্তি হলো গ্রামে। এখানে মুক্ত পরিবেশে মুক্ত নিশ্বাস ফেলা যায়।

গ্রামের নির্মল বাতাসে শরীর ও মন জুড়িয়ে যায়। উপরন্তু করোনার আশীর্বাদে প্রকৃতি সেজেছে এক নতুন রুপে সতেজ ও সবুজ হয়ে উঠেছে ময়লা, আবর্জনায় ঢাকা থাকা প্রকৃতি। গ্রামে এখন পাখ-পাখালির কলরব শোনা যায় নিয়মিত। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ যেন প্রকৃতিতে যেন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে। শিল্প কল-কারখানা বন্ধে খাল-বিল, নদী-নালার এবং পরিবেশ দূষণ কমেছে। বাহারি রকমের দেশীয় ও বনজ ফুলে অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়েছে প্রকৃতি। দূষণ কমিয়ে যাওয়ায় জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদগুলো ফিরে পেয়েছে চাঞ্চল্যতা।

নদীগুলোতে মাছ এবং বিচিত্র রকমের জলজ প্রাণীর আনাগোনা বেড়েছে। নদীর পাড়ে গেলেই মনটা জুড়িয়ে যায় মনে হয় এ যেন এক অন্য রকম পৃথিবী। প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য আমার মন কেড়েছে। তাই দুর্যোগ মহামারীর কারনে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও নিজেকে আবিষ্কার করেছি ভিন্নভাবে। তবে সবকিছুর মধ্যেও ভালোলাগা গুলোকে নিছক মনে হয়। যখন টিভি খুলে দেখি খেলার স্কোরের মতো মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছেন না। অবহেলায় অযত্নে পড়ে রয়েছে নিথর দেহ গুলো।

জীবন জীবিকা যদি স্থবির হয়ে যায় তাহলে কোন কিছুরই মূল্য নেই। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে সার্বক্ষণিক প্রার্থনা করি যেন খুব দ্রুত পৃথিবী সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠে। খাবার তাড়নায় কিংবা করোনায় মৃত্যুর জন্য যেন আর কোন কান্না শুনতে না হয়। ভালো থাকুক পৃথিবী, ভালো থাকুক প্রিয় মানুষ গুলো।

লেখক: শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence