শত নিষেধাজ্ঞাতেও সফল ইরান

ইরফান রিয়াদ
ইরফান রিয়াদ  © টিডিসি ফটো

রণাঙ্গনে শুধু অস্ত্রের ব্যবহারই জয় এনে দিতে পারে না। বুদ্ধিমত্তা, সুশৃঙ্খল রণকৌশল যুদ্ধ জয়ের পথ সুগম করে তোলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ সল্প অস্ত্র দিয়ে সুশৃঙ্খল রণকৌশল তারই একটি দৃষ্টান্ত।

আমেরিকান বাহিনীর ভারী অস্ত্র আর নিয়মিত বোমাবর্ষণে ভিয়েতনামী সৈন্যরা যখন দিশেহারা তখন তারা টানেলে থেকে যুদ্ধের অভ্যাস গড়ে তোলে। যুদ্ধে এমনও হয়েছে, যেখানে আমেরিকান সৈন্যদের জয় প্রায় সুনিশ্চিত দেখা যেত হঠাৎ ভুমি ফুরে সেখানে শত্রুর ঘাঁটির সবচেয়ে নিরাপদ স্থান দিয়ে উঠে এসে আমেরিকানদের পেঁছন থেকে আক্রমণ করে মুহূর্তেই তছনছ করে দিত সব আনন্দ। মাটির নিচে টানেল খুঁড়ে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ভিয়েনামিরা যেভাবে শক্তিশালী আমেরিকা সাম্রাজবাদের পতন ঘটিয়েছিল তা পরবর্তী দুনিয়ার কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আমেরিকা এখনও তাদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব থেকে সরে আসেনি। ইরানের প্রতি বিরুপ মনোভাব তারই প্রমাণ।করোনা দুনিয়ার সব দেশকে টলাতে পারলেও কর্তৃত্ববাদী শাসকদের টলাতে পারে নি।

করোনার ভয়াল থাবায় রেহাই পায়নি ইরানও। ইরানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭২ হাজার ছাড়িয়েছে। এমন দুর্যোগে যেখানে প্রত্যেকটি দেশের উচিত একে অপরকে সাহায্য করা। সেখানে আমেরিকা এখনও তাদের কর্তৃত্ব বলবৎ রাখতে ভুলেনি। ইরানের ওপর সকল প্রকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে।

ইতোমধ্যে করোনা মোকাবেলায় ইরানের জন্য আইএমএফের দেওয়া অর্থ সাহায্য আটকে দিয়েছে মার্কিন সরকার।এরকম সংকটেও ইরানকে একঘরে করতে একাট্টা মার্কিন মুলুক।

কিন্তু আমেরিকার সাম্রাজবাদী যুদ্ধে ইরান কাজে লাগিয়েছে তার বুদ্ধিমত্তা। সুকৌশলে ইরান করোনা মোকাবেলায় হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পুর্ণ। এতো সকল বাধা, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান যেভাবে করোনা মোকাবিলায় এগিয়ে গেছে অন্যান্য দেশের জন্য তা দৃষ্টান্ত।

ইরানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হতে শুরু করে চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। দেশটির প্রশাসন আর ডাক্তারের পরিশ্রমের ফলে দেশটির দৃঢ় অবস্থান ফুটে উঠেছে।

এরই মধ্যে ইরান করোনাভাইরাস সংক্রমণ নির্ণয়ে অত্যাধুনিক চৌকস সক্ষম প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও সিটি স্কিন। যার সাহায্যে সহজে নির্ণয় করা যাবে করোনা সংক্রমণ। রোবট প্রযুক্তির মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে করোনা নির্ণয়ের ফলে ডাক্তারদের মাঝে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে গেছে।

করোনা মোকাবিলায় এসব প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী তৈরি করছে ইরানের বিশেষজ্ঞরা নিজেরাই। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে আইসিইউতে রোগীর অক্সিজেন সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটরও তৈরি করছে তারা। ইরানের বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে করোনা নির্ণয়ের কিট তৈরিতেও সক্ষম হয়েছে। সপ্তাহে ১ লাখ কিট তৈরিতে সক্ষম তারা। এখন বিদেশেও ইরান কিট রপ্তানি করতে পারবে।

করোনা সংক্রমণ পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে ইরানি কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত মাস্ক তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা চাহিদার ৪ গুণ বেশি মাস্ক তৈরি করেছে। এগুলো দিয়ে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর চাহিদা পুরণ করতে পারবে।

শত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও করোনা প্রতিরোধে ইরানের এসব পদক্ষেপ স্বাবলম্বী হওয়ার বার্তা বহন করে। কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে এরকম নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার কথাই বলেছিলেন। কিন্তু আফসোস নজরুলের এই বাণী আমরা বাঙালিরা শুনতে পাইনি, কিন্তু ইরানীরা হাজার হাজার মাইল দুরে থেকেও নজরুলের সেই বাণী শুনতে পেয়েছে।

আমাদের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও আমরা স্বাবলম্বী নই। না আমরা কৃষিতে স্বাবলম্বী হতে পেরেছি, না পেরেছি টেকনোলজিতে। এ যেন পরের ঘাড়ে যতদিন বসে খাওয়া যায় সেরকম অবস্থা।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বদিচ্ছার অভাবে বারবার পিছিয়ে পড়ি আমরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার জন্য যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ না দেওয়া আমাদের পরনির্ভরতার মুল কারণ। গবেষণার অভাব আর প্রশাসনের অনিহার কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখনও ভেন্টিলেটর বা কিট তৈরি করতে পারেনি। গবেষণায় যেটুকু বাজেট আসে তাও দলীয় ভিসি থাকায় ক্ষমতাসীনদের ভাগবাটোয়ারায় তলানীতে এসে পড়ে।

দিনশেষে সবকিছুর জন্য সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে হয় চীন বা মার্কিন সরকারের কাছে। এরকম পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলোর উচিত ইরান থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট


সর্বশেষ সংবাদ