নেগেটিভ রেজাল্ট এত পজিটিভ হতে পারে— এই জানলাম
- বাসবী খাঁ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২০, ১২:০৯ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:১১ PM
বেশ কিছু দিন ধরে সর্দি, খুসখুসে কাশি, গলা ব্যথা চলছিল। সে ভাবে পাত্তা দিইনি। মার্চ মাসের এক শনিবার, ১৪ তারিখে, আমাদের একটা জমায়েত ছিল। আমরা সবাই প্রবীণ নাগরিক, সবারই বয়স ৬০-এর চেয়ে বেশি।
একসঙ্গে বাঙালি রান্না খাওয়ার সুযোগ তো কমই পাওয়া যায়। তাই দারুণ ভোজ তো বটেই, গান, গল্প, আড্ডা— সব মিলিয়ে খুব আনন্দ হল। মোনিকা নামে একজন জার্মান বন্ধু আমাদের ওই জমায়েতে এসেছিল। আলাপ করে বেশ ভাল লাগল। সোমবার থেকে আমার শরীর বেশ খারাপ। জ্বরও এল। তাপমাত্রা ১০১.৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আমার স্বামীও পরের দিন থেকে অসুস্থ হলেন। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা ‘সেলফ আইসোলেশন’-এ থাকতে শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে আমার এক দিন নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হল। আমার স্বামীর বুকেও বেশ ব্যথা। কী যে করি? একান্ত এমার্জেন্সি ছাড়া ডাক্তাররা সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করেছেন।
এর মধ্যে আমরা খবর পেলাম যে, মোনিকা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ আছে। আমাদেরও প্রায় সব উপসর্গই রয়েছে। আমরা দু’জনেই ষাটোর্ধ্ব। বেশ ভয় পেয়ে ভাবলাম, এ বার তো ডাক্তারকে ফোন করে বলা দরকার। সব শুনে, বিশেষত আমরা এক জনের সংস্পর্শে এসেছিলাম যার করোনা পসিটিভ, এটা শুনে বললাম যে, খুবই চিন্তার বিষয়। উনি আমাদের হয়ে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে করোনা টেস্ট করার জন্য যোগাযোগ করলেন।
এর প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্বাস্থ্য দফতর থেকে ফোন এল। ওরা বেশ কিছু তথ্য জেনে নিলেন। বললেন, মোবাইল ইউনিট নিয়ে ডাক্তার পরের দিন আসবেন টেস্ট করার জন্য। জানালেন, পৌঁছনোর ১০ মিনিট আগে তাঁরা ফোন করবেন। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হল যে, ওই মুহূর্ত থেকে আমরা গৃহবন্দি। দরজার বাইরে যাওয়াও নিষেধ। সেই দিনই মোবাইল ইউনিট নিয়ে ডাক্তার এলেন। নাক ও গলা থেকে সোয়াব নিয়ে বললেন, শ্বাসকষ্ট বাড়লে দেরি না করে ইমার্জেন্সি-তে যেন ফোন করি। আর প্রতি দিনের ডায়েরি তৈরি করতে হবে রক্তচাপ আর তাপমাত্রা সহ। বলা হল, রিপোর্ট ফোন করে জানানো হবে।
সেটা এক শুক্রবার. আমাদের বাজার করার দিন। পাউরুটি, সবজি ও ফল বাড়ন্ত। কিন্তু আবার একটি ফোন জানাল যে, তালিকা করে ইমেল করলে প্রয়োজনীয় জিনিস আমাদের দরজায় পৌঁছে দেওয়া হবে। পেমেন্ট করতে হবে অনলাইনে।
সে যাই হোক। এ দিকে শনি, রবি, সোমবার চলে গেল। সেই ফোন আর আসে না। মানসিক চাপ বেড়ে চলেছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক্তচাপ। খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেল। পরিজনহীন বিদেশে বসে আমার মনের অবস্থা তখন বলার বাইরে। দু’জনকেই যদি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তার জন্য আমরা সুটকেসও তৈরি রাখলাম।
অবশেষে বৃহস্পতিবার ফোন এল। নেগেটিভ। নেগেটিভ যে এত পজিটিভ বার্তা আনতে পারে! আনন্দে চোখ ছলছল। কী স্বস্তি! আমরা বয়স্করা এই রোগের সহজ টার্গেট। তবে আরও অনেক দিন সাবধানে থাকতে হবে বাড়িতে।
জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এক লক্ষ ২২ হাজার। মৃত্যুর হার কম হলেও এটা কিন্তু চিন্তার বিষয়। এখানে একটা কথা না বললে ভুল হবে, যে মূহূর্তে আমরা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, খুব দ্রুত সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুধু চিকিৎসারই নয়, অন্যান্য সব কিছুরও।
এই লেখাটা যখন লিখছি, আমাদের বাইরে যাওয়া মানা। সোনালি দিনগুলোতে প্রকৃতির শোভা অতুলনীয়। বারান্দায় বসে দেখছি আর সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রার্থনা করছি।
*লিখেছেন জার্মানির ব্রান্সউইক থেকে