ভিলওয়ারা মডেল, করোনাভাইরাস এবং বাংলাদেশ

মো. হাসান তারেক
মো. হাসান তারেক  © টিডিসি ফটো

সারাবিশ্ব এখন লড়াই করছে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। করোনার বিরুদ্ধে এই মহাযুদ্ধে জয়লাভের জন্য সারাবিশ্বের আক্রান্ত দেশগুলো সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণ, লকডাউনের মত শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে, করোনাভাইরাসও সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। বিশ্বের শক্তিশালী নেতাগণ দিন-রাত এক করে করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য নিয়ত লড়ে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে, দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম সনাক্ত হয় ৮ মার্চে। তারপর থেকে নিয়ত জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা। সারাদেশব্যপী এখন অঘোষিত লকডাউন বিরাজ করছে।

তবে, অনেক স্থানে মানুষ বেরিয়ে পড়ছে লকডাউন ভেঙ্গে রাস্তায় জীবন ও জীবিকার টানে। জনগণ, সরকার ও স্থানীয় প্রতিনিধির মধ্য অনেক জায়গায় সমন্বয়হীনতার দেখা মিলছে। যা নিঃসন্দেহে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। আবার, অনেক জায়গায়, অনেক তরুণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগ জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছে।

এই উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করতে যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দিশেহারা সেখানে বাংলাদেশের মত দেশগুলোকে এই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে দায়িত্বশীলতা ও সততার পরিচয় দিতে হবে। শুধু সরকারের একক উদ্যোগ এখানে পর্যাপ্ত নয়। জনগণকে হতে হবে নিজের জায়গা থেকে সচেতন। জনগণকে সরকারের ঘোষিত পদক্ষেপ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্ র নির্দেশনাগুলো কার্যকরীভাবে মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা ও অসচেতনতা দেখা যাচ্ছে।

প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে মানুষ বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে আসছে, যেখানে বার বার সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে। সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের মত দেশের পক্ষে পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ এখন করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। এই ধাপে করোনার স্হানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ঘটবে। একারণে, করোনা সংক্রমণের এই ধাপে জনসচেতনতা ও জন উদ্যোগ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। এই পর্যায়ে সরকারকে করোনার হটস্পটগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে।

পাশাপাশি, এই অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোকে পুরোপুরিভাবে লকডাউন করে ফেলতে হবে। এখন পযর্ন্ত বাংলাদেশে করোনার হটস্পট হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার কিছু এলাকা ও নারায়ণগঞ্জ।

অধিক সংক্রমিত এই এলাকাগুলো লকডাউন করা হলেও জনগণ মানছে না কিছুই। যারা জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, জীবনাচারণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে তারা জনগণের কার্যক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছেন। এইভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এই কারণে, সরকারের উচিত হবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। উদাহরণ হিসাবে, আমরা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের একটি জেলা শহর ভিলওয়ারার মডেলের কথা উল্লেখ করতে পারি। ইতিমধ্যে এটি ‘ভিলওয়ারা মডেল’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতির মূলকথা হচ্ছে, ‘রুথলেস কন্টেইনমেন্ট’ যার মানে হচ্ছে, মানুষজনকে শক্তভাবে ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে হবে।

ভারতের অন্যতম টেক্সটাইল প্রধান এলাকা হচ্ছে এই ভিলওয়ারা। ১৯ মার্চ এখানে প্রথম সংক্রমণ দেখা যায়, মাত্র চারদিনের ভেতর সেখানে ১৩ জন করোনা পজিটিভ সনাক্ত হন আর ৩০ মার্চের মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে যায় ২৬। কিন্তু, এরপর ঘটে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন, পরবর্তী দশদিনে পুরো জেলায় আর মাত্র একজন রোগী সনাক্ত হয়েছেন। ততক্ষণে, সুস্হ হয়েছেন সতেরো জন।

এখন প্রশ্ন হলো, এই অসাধ্য সাধন হলো কিভাবে? এই অসাধ্য সাধন হয়েছিল জনগণের সহায়তায়, জনগণের সদিচ্ছায়। করোনা সনাক্ত হওয়ার পর পরই ভিলওয়ারার বেসরকারি যানবাহন বা ভ্যানের চলাচল সর্ম্পূণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যতগুলো পজিটিভ কেস এসেছিল তার সবগুলোর ক্লাস্টার ম্যাপিং তৈরি করা হয়। পুরো জেলায় হাজার হাজার লোককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।

২২ মার্চের মধ্যেই রাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগ ও জেলা প্রশাসন সাড়ে আটশো টিম গড়ে তুলে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ শুরু করে দেয়। এরপর, যাদের ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখা যায়, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ জনগণ মানছে কি না তা দেখার জন্য একটি অ্যাপের মাধ্যমে তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করা হতে থাকে।

তাছাড়া, গোটা এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। জনগণের স্বার্থে পুলিশ বাড়ি বাড়ি খাবারদাবার ও ঔষুধের হোম ডেলিভারি দিয়ে আসে। এই কার্যক্রমগুলোর কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ভিলওয়ারা এখন সফলতার মুখ দেখছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশও যে জায়গাগুলো করোনার হটস্পট হিসাবে চিহ্নিত সেগুলোতে ভিলওয়ারা মডেল প্রয়োগ করতে পারে। তবে, আমাদের এক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা লাগবে।

কেননা, স্থানীয় প্রশাসনে যারা কাজ করছেন তারা নিরলসভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও জনগণ বুঝছে না। এক্ষেত্রে, এসকল এলাকায় কারফিউের মত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, আইন অমান্যকারীদের জন্য যথাযথ আইনীব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

একটি অ্যাপের মাধ্যমে আক্রান্তের গতিবিধি ট্র্যাক করা যেতে পারে। চীনের উহান শহরেও এভাবে নাগরিকদের গতিবিধি ট্র্যাক করা হয়েছিল। তবে, ভিলওয়ারা মডেলকে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে হলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য আগে খাদ্যসংগ্রহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বণ্টন ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে হবে। যেন সাধারণ মানুষ ও সরকারের মধ্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠে।

জনগণ ও সরকার যদি পরস্পরকে সহযোগিতা না করে তাহলে বাংলাদেশে যেমন করোনার বিস্তার বাড়বে তেমনি সামনের যে অর্থনেতিক মন্দার আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা মোকাবিলাও কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘সকলের তরে সকলেই আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। নতুবা, আমাদের এই সীমাবদ্ধ সম্পদ দিয়ে লড়াই কঠিন হয়ে যাবে। অতএব, আমাদের এই যৌথ উদ্যোগগুলোই আমাদের জয়ী হবার জন্য বড় শক্তি।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,ডক্টর মালিকা কলেজ,ঢাকা।


সর্বশেষ সংবাদ