বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের আবশ্যকতা
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২০, ০৪:৫৫ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১২ PM
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যাকাত একই সাথে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক একটি ব্যবস্থাপনা। সুষ্ঠুভাবে যাকাত আদায়ে একটি দেশের অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। সেহিসাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
যাকাত আরবি শব্দ। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বর্ধিত হওয়া, বৃদ্ধি করা, মার্জিত করা, সংযুত করা, পূর্ণতা, নির্দোষ, সততা ইত্যাদি।বছর শেষে নিজের অধীনে যে ধন-সম্পদ থাকে এবং তা যদি যাবতীয় খরচ বাদে পরিমাণে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যের হয় তাহলে শতকরা অাড়াই শতাংশ হারে গরিব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করাকে যাকাত বলা হয়। 'Payment made annually under Islamic law on certain kinds of property and used for charitable and religious purpose, one of the Five pillars of Islam.'(Oxford Dictionary)। যাকাত প্রদানে সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন-'আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তোমরা যে যাকাত দাও, মূলত যাকাত দানকারী সম্পদ বৃদ্ধি করে।'( সূরা রুম-৩৯)।
যাকাত ইসলামের অন্যতম প্রধান বাধ্যতামূলক ইবাদত। ঈমানের পর নামাজ আর নামাজের পরই যাকাতের স্থান। এ সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে।হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো - এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা এবং হজ্ব করা।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলিল অনুযায়ী এটা প্রমাণিত হয় যে, যাকাতকে আল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন। ইসলামী শরীয়ার সমস্ত উৎস অনুযায়ী যাকাত ফরয আইন। যেমন কুরআনের সূরা বারাকার ৪৩, ৮৩, ১১০, আন-নিসার ৭৭, আল-হজ্ব-এর ৭৮, আন-নূর-এর ৫৬, আহযাব-এর ৩৩, মুজাদালার ১৩, মুযাম্মিলের ২০নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন, ‘নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান কর’।কুরআন শরীফের প্রায় ৩২ জায়গায় নামাজের সঙ্গে যাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাত কারা পাবে অর্থাৎ কাদের মধ্যে যাকাতের অর্থ বণ্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে তিনি বলেন-'এসব সাদাকাতো (যাকাত) কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তাওবা-৬০)
উপরের আয়াত হতে আটটি উদ্দেশ্যে যাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে-১. দরিদ্র জনসাধারণ, ২. অভাবী ব্যক্তি, ৩. আমিল বা কর্মচারী যাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছে, ৪. নওমুসলিম, ৫. ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি, ৭. আল্লাহর পথে মুজাহিদ এবং ৮. মুসাফির।
যাকাতের আটটি খাতের চারটিই দরিদ্র অসহায়দের সাথে সংশিষ্ট।আল্লাহ তায়ালা বলেন,তাদের সম্পদে অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের। (যারিয়াত- ১৯)। উক্ত আয়াত সুস্পষ্ট ভাবে নির্দেশ করছে যে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রার্থীদের জন্যে সম্পদ ব্যয় করা উচিত।
যাকাত আদায় করা ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব। এ সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনে বলেন-'তারা হচ্ছে সেই সব লোক, যাদেরকে আমি রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত ব্যবস্থা চালু করবে, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।' (সূরা হজ্জ-৪১ )।আল্লাহ আরও বলেন-'হে নবী, তাদের সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করো।' (সূরা তাওবা-১০৩)।
এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলে করীমকে (সা.) মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দান করতে বলা হয়নি।এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম সকলের নিকট থেকে যাকাত আদায় করবে এবং সমষ্টিগতভাবে তা খরচ করবে।একটি হাদীসেও নবী করীম (সা.) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন-'তোমাদের বিত্তবানদের থেকে যাকাত আদায় করে তোমাদের দরিদ্রদের মধ্যে তা বণ্টন করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।
দরিদ্র কারা? বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দৈনিক এক ডলার ৯০ সেন্ট বা ১৬২ টাকার কম যারা আয় করেন তারা দরিদ্র।অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ২১.৮%। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের দারিদ্র্য ২০.৫ %। সেহিসাবে দেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ২৮ লাখ। দেশে হত দারিদ্র্য ১০. ৫%।সংখ্যায় যা এক কোটি ৬৮ লাখ।এক রিপোর্টে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমান পঞ্চম। বাংলাদেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে।দারিদ্র্য বিশ্ব মানবতার কাছে বহুল পরিচিত একটি শব্দ। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবন যাত্রার নূন্যতম দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যাকাতের দ্বারা গরিব, অক্ষম, অভাবগ্রস্ত, লোকদের পূর্ণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করা যায়।পবিত্র কুরআনের যাকাত বন্টনের যে ৮টি খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে ৪টি খাতই সর্বহারা, অসহায়, অভাবগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত।
কয়েক বছর আগে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) এর পক্ষ থেকে বলা হয়। বাংলাদেশ যাকাত যোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা। এর আড়াই শতাংশ হারে যাকাতের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর বাংলাদেশে যে পরিমাণ মোট সম্পদ আছে তাতে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করে বন্টন করা সম্ভব।যদিও বর্তমানে যাকাত এরচেয়ে বেশি আদায় সম্ভব।
২৫ হাজার কোটি টাকা যা বাংলাদেশের বার্ষিক মোট উন্নয়ন কর্মসূচীর ৪০ শতাংশ। যদি এই ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যায়, তাহলে সেই অর্থ সমভাগে ১৫ লাখ মানুষকে বিতরণ করলে তাদের প্রত্যেকের ভাগে দেড় লাখ টাকারও বেশি পড়বে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে! যদি এ দেড় লাখ টাকা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেয়া যায় তাহলে দুই-তিন বছর পরে আবার তারাই যাকাত দেয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহা. আবদুল মজিদ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হলে দেশে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব। কিন্তু যাকাত ব্যবপস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই দেশে বৈষম্য বাড়ছে।'
সিজেডএম যাকাত আদায়ের সম্ভাবনার কয়েকটি খাত উল্লেখ করেছে।সেই খাত গুলো হলো, প্রতি বছর ফসলি জমির মালিক এক হাজার কোটি, মায়েদের গচ্ছিত স্বর্ণ অলংকারে একশ কোটি, ব্যাংকিং খাতে ১ হাজার ২৪০ কোটি, শিল্প কারখানা থেকে এক হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব।
এছাড়া সঞ্চয়পত্র ও বন্ড থেকে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে এক লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন কোটিপতি রয়েছেন।তাদের গবেষণায় আরো উঠে এসেছে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করলে ১৫ বছরে বাংলাদেশে যাকাত নেওয়ার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটি ব্যাংকের গবেষণা তথ্যমতে, শুধু মানুষের ব্যাংকে গচ্ছিত জমা টাকার আমানত থেকেই ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার যাকাত আদায় করা সম্ভব। মুসলিম দেশ হিসেবে এশিয়ারই একটি দেশ মালয়েশিয়া যাকাত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করে সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে যে যাকাত ব্যবস্থাপনা রয়েছে তার মাধ্যমে সে স্বপ্ন পূরণ করা যাবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বিগত দশ বছরে ইসলামী ফাউন্ডেশনের যাকাত বোর্ড মাত্র ১৮ কোটি টাকা আদায় করেছে যা খুবই অপ্রতুল।যাকাত ফান্ডের গত ১০ বছরে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের পরিসংখ্যান দেখা যায়, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট যাকাত সংগ্রহ হয়েছে ১৭ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ টাকা। উল্লেখিত সময়ে সংগ্রহের বিপরীতে যাকাত বণ্টন করা হয়েছে ১৭ কোটি ৯০ লাখ ৭১ হাজার ৩২২ টাকা। যার মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সংগ্রহ হয়েছে ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৬ টাকা, বণ্টন হয়েছে ৭২ লাখ ৮ হাজার ১ টাকা। পরবর্তী ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংগ্রহের পরিমান অনেক বেড়ে যায়। এ বছর যাকাত সংগ্রহ হয়েছে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৮ টাকা, যার পুরোটাই বণ্টন দেখানো হয়েছে। এর পরবর্তী ধীর গতিতে বেড়েছে যাকাত সংগ্রহের পরিমান। এভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যাকাত সংগ্রহ হয় ৩ কোটি, ২১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫৫ টাকা, বণ্টন হয় একই পরিমান অর্থ। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যাকাত সংগ্রহ হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। যা বণ্টনের কার্যক্রম চলছে।
তবে যাকাত ফান্ড ১৯৮২ সালে শুরু করেই বছরটিতে ১৫ লাখ ১২ হাজার ৩৭ টাকা সংগ্রহ করে। এরপর প্রতিবছরই বেড়েছে এর সংগ্রহের পরিমান। তবে তা আশানুরূপভাবে বাড়েনি বলে মনে করেন ফান্ড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাই এখন যাকাত আদায়ে বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। যাকাতের অর্থে ঋণ সহায়তা, কৃষককে হালের বলদ, গরীব ছেলেমেয়েদের ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ, বিধবা আসহায় নারীদের সেলাই মেশিন, কর্মক্ষম পুরুষদের রিক্সা প্রদান, প্রতিবন্ধীদের দোকান করে দেওয়া যায়। এভাবে যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সুষ্ঠু ভাবে যাকাত আদায়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। যাকাত প্রদানের নামে সারিবদ্ধভাবে গরীব অসহায়দের লুঙি শাড়ি বিতরণে যাকাতের হক আদায় হবে না এবং দেশের দারিদ্র্য বিমোচনেও ভূমিকা রাখতে পারবে না। মনে রাখতে হবে যাকাত গরীবের প্রতি ধনীর অনুকম্পা নয় বরং এটি গরীবদের ন্যায্য অধিকার।যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে।আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যারা সোনা বা রূপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপালের পার্শ্বদেশ এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে সেদিন বলা হবে এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর। (সুরা তওবা ৩৪-৩৫)।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক