হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বিতর্ক এবং ইসলাম কী বলে?
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২০, ০১:১৬ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১০ PM
বাংলাদেশে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে। ২০১৬ সালে একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকার মাতুয়াইলে প্রথমবারের মতো এতিম-বিপন্ন শিশুদের জীবন বাঁচাতে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হয়। মাতুয়াইলে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী অধ্যাপক ও হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়কারী ডা. মুজিবুর রহমান এটি স্থাপন করতে সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ সহায়তা নেননি ৷ নিজে এবং দানশীল ব্যক্তিদের অর্থায়নে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।বিদায়ী বছরের ১ ডিসেম্বরে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের কাজ শুরুর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়৷ কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে এটি উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি৷ প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকে ৫০০ লিটার মায়ের দুধ সংরক্ষণ করা যাবে৷ এখানকার দুধ পাস্তুরিত করাসহ সংরক্ষণের যন্ত্রপাতি স্পেন থেকে আনা হয়েছে।
শিশু তার মায়ের দুধ না পেলে অন্য কোন মায়ের বুকের দুধ যাতে পান করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউএইচও৷ এই প্রয়োজনের নিরিখেই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্ভব। ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের উদ্যোগে ১৯৮০ সালে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়ে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা বলে। A human milk bank is a service established for collecting, screening, processing, storing and distributing donated human milk.মূলত মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণের জন্য হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বা মায়ের বুকের দুধের আধার।
বাংলাদেশের অনেক শিশু মায়ের দুধ পায় না।তাদের জন্য এই মিল্ক ব্যাংক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর দুই কোটি শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। এই ধরনের নবজাতকদেরকে মায়ের বুকের দুধ পান করানোর উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে সংস্থাটি৷ পাশাপাশি যেকোনো নবজাতককে জন্মের পর থেকে অন্তত ৬ মাস মাতৃদুগ্ধ পান করার পরামর্শ ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক থেকে যেসব শিশুদের দুগ্ধ পান করানো হবে। যেসব শিশুর মা নেই, যে মা তার শিশুকে বুকের দুধ দিতে সক্ষম নন,যে নবজাতকের জন্মের পরই মা মারা গিয়েছেন বা যাদের মা অসুস্থতার জন্য দুধ খাওয়াতে পারছেন না,আবার যেসব নবজাতক মায়ের কাছে থাকতে পারছে না,যেসব নবজাতকদের পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে বা যেসব নবজাতককে দত্তক নেওয়া হয়েছে এবং মায়ের দুধের অভাবে যাদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছা়ডা, স্ক্যানো ও এনআইসিইউতে থাকা অপরিণত শিশুদেরও সংরক্ষণ করে রাখা দুধ খাওয়ানোর কথা ভাবা হয়েছে।কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান মতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ২৫ জন মাতৃহীন, ৩৭ জন দত্তক শিশু ছিল। এদের বড় অংশই মারা যায়।এদের বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হলে এই শিশুরা বেঁচে যেত।
সেই সব শিশুর জন্য এই ধরণের উদ্যোগ অনেক উপকারী হবে বলে হিউম্যান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এমন অভিমত কর্তৃপক্ষের ।একজন নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই। বুকের দুধ খাওয়ানো যায় না বলেই কেবল অনেক শিশু মারা যায়। বেঁচে থাকলেও অনেকে সারাজীবনের জন্য অপুষ্টিতে ভোগে, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে ওঠে। এছাড়া যেসব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ ছাড়া বাঁচানো যাচ্ছে না, সেসব বাচ্চাকেই এই দুধ খাওয়ানো হবে।
কারা এই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুগ্ধ জমা রাখবেন? যেসব মায়েদের সন্তান জন্মের পর মারা গিয়েছে বা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর পরও মায়ের বুকে অতিরিক্ত দুধ আছে , সেসব মায়েরা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন ।এছাড়া এখানে কর্মজীবী মায়েরা তার নিজ শিশুর জন্যও দুধ রেখে যেতে পারবেন৷এই মিল্ক ব্যাংকে দুগ্ধ জমা রাখা ও গ্রহণের জন্য কোনো অর্থ লাগবে না৷ প্রয়োজন নিশ্চিত হয়েই শিশুকে দুধ দেয়া হবে৷ এই ব্যাংকে তিন মাস থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত দুধ শিশুদের খাওয়ার উপযোগী থাকবে৷
হিউম্যান ব্যাংকের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় এর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অাধুনিক কালে প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে ব্রাজিলে৷এরপর ১৯৮৫ সালে দেশটিতে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়৷ ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্রাজিলিয়ান নেটওয়ার্ক অফ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকস৷ শুধু নিজ দেশে নয় গোটা ল্যাতিন আমেরিকায় মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা দেয় তারা৷ ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই অঞ্চলে এখন ৩০১টি সংরক্ষণাগার রয়েছে যার ২১৮টিই ব্রাজিলে৷ ইউরোপের ২০ টির বেশি দেশে মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণাগার রয়েছে৷ সব মিলিয়ে যার সংখ্যা ২৩৯টি বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন৷ আরো ১৫ টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে৷ এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ৩৭টি ব্যাংক আছে ইতালিতে৷ ফ্রান্সে ৩৬টি, সুইডেনে ২৮টি আর জার্মানিতে রয়েছে ২০টি৷ এশিয়ায় প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক যাত্রা শুরু হয় ভারতের মুম্বাইতে ১৯৮৯ সালে৷ বর্তমানে ভারতে প্রায় ৫০ টি মিল্ক ব্যাংক রয়েছে৷ভারতের রাজীব গান্ধী মেডিক্যাল কলেজে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে।
চীনেও এমন ব্যাংক আছে অনেকদিন থেকে ৷ ২০১৭ সালে সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম তাদের প্রথম মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে৷ ২০১৫ সালে থেকে এই উদ্যোগ চালু রয়েছে ফিলিপিন্সেও৷জানা যায় মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে ইরান তাবরিজ শহরে প্রথম মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে৷ গত বছরের আগস্টে পঞ্চম ব্যাংকের উদ্বোধন করা হয়েছে সিরাজ শহরে৷ ২০১২ সালে তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশটিতে এ ধরনের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়৷ তবে এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি।বাংলাদেশে এর প্রতিষ্ঠা ডা. মুজিবুর রহমান জানান বিশ্বের অনেক দেশে তিনি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক পরিদর্শন করেন৷ কুয়েত, ইরান, ইরাক ও পাকিস্তানের মত মুসলিম দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন৷ তাদের নিয়ম দেখে এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে কথা বলে তিনি বাংলাদেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামী চিন্তাবিদদের সামনেও তিনি এটা উপস্থাপন করেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন , 'আমি নিজে মুসলমান তাই ধর্মীয় কারণে এটা বিরোধিতা করার কোনো কারণ দেখছিনা।
এদিকে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলেম ওলামারা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। একপক্ষের দাবি, এই ধরনের প্রচেষ্টা ইসলাম সম্মত নয়। অন্যপক্ষের মতে, এটি একটি ভালো উদ্যোগ।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের বিপক্ষের আলেমদের অভিমত এটি নিঃসন্দেহে একটি মানবিক কাজ। নবজাতক শিশু নিজ মায়ের অবর্তমানে অন্য মায়ের দুধ পান করবে, বিষয়টি ইসলামে অনুমোদিত। আমাদের প্রিয় নবি (সা.) বিবি হালিমার দুধ পান করেছিলেন। মায়ের দুগ্ধের সংকটের কারণে তখনকার আরব সমাজে এই রীতি প্রচলিত ছিল। বর্তমান সময়েও ইসলামে এই ব্যবস্থা বহমান রয়েছে। কোনো নবজাতকের মা মারা গেলে বা অসুস্থ হলে বা বুকের দুধের সংকট দেখা দিলে অন্য মায়েরা যাতে এগিয়ে আসেন, ইসলাম এ ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। তবে অন্য মাতৃদুগ্ধ পান করার ক্ষেত্রে ইসলামের যে নির্দেশনা রয়েছে তা পালন করা আবশ্যক।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের ফলে মুসলিম বিবাহপ্রথা হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে বলে ওলামাদের আশংকা। যে বাচ্চাটি মিল্ক ব্যাংক থেকে দুধ সংগ্রহ করে পান করবে, সে কিভাবে শনাক্ত করবে, তার দুধমা কে? এবং কতজন? এবং সে এটিও শনাক্ত করতে পারবে না, কার কার সঙ্গে তার বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন হয়ে বিয়ে হারাম হয়ে রয়েছে। সন্তান না হয়েও একই মায়ের দুধ যারা খান তারা দুধ ভাই বা দুধ বোন ৷ তাদের মধ্যে বিবাহ ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ। তাই এধরনের মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও হারামের আশঙ্কা থেকে যাবে।
ইসলামে ১৪ শ্রেণীর নারীর সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে একটি শ্রেণী হলো দুধ ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘(বিয়ের জন্য) তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, তোমাদের মেয়ে, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুপু, তোমাদের খালা, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে এবং (আরো হারাম করা হয়েছে) সেই সব মা, যারা তোমাদের বুকের দুধ পান করিয়েছেন, তোমাদের দুধবোন, তোমাদের স্ত্রীদের মা, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা একান্ত মিলিত হয়েছ তাদের আগের ঔরসজাত মেয়েরা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে রয়েছে, আর যদি তোমরা তাদের সঙ্গে একান্ত মিলিত না হয়ে থাকো, তবে তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই এবং (তোমাদের জন্য বৈধ নয়) তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রীগণ। দুইবোনকে একত্র করাও (তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে)।(সুরা নিসা আয়াত- ২৩ )।কোনো শিশু দুই বছর বয়সের মধ্যে কোনো মহিলার দুধ পান করলে সেই মহিলার দুধসন্তান হয়ে যায়। ফলে ওই মহিলার সন্তানরা তার দুধ ভাই-বোন হয়ে যায়। চাই মহিলার স্তন থেকে সরাসরি পান করুক, চাই দুধ বের করে অন্য মাধ্যমে পান করুক। (ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত : ৬/২৩২)।
দুই বছর বয়সসীমার মধ্যে যে শিশু অপর মায়ের দুধ পান করবেন ঐ নারী তার দুধমা এবং তার সন্তানেরা ঐ শিশুর দুধ শরিকি ভাই-বোন হবেন। এই দুধপান সরাসরি হোক বা যেকোনো উপায়ে হোক। রক্ত সম্পর্কীয় কারণে মায়ের যেসব আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম, দুধপানের ক্ষেত্রে দুধমায়ের সেসব আত্মীয়ের সঙ্গেও বিয়ে বৈধ হবে না। (ফাতওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩২)৷ইরান, কুয়েত, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত ও পাকিস্তানেও মিল্ক ব্যাংক থাকার কথা বলা হলেও অনেক আলেম দাবি করেছেন মুসলিম বিশ্বের কোথাও এ ধরনের পদ্ধতি চালু নেই। বিষয়টি ৫৭ টি ইসলামি দেশগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থা ওআইসির ফিকহ বোর্ডে উত্থাপিত হলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ তা হারাম ঘোষণা করেছেন।ওআইসি’র ইসলামি ধর্মীয় বিধান বিষয়ক বোর্ড ‘মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী’ (International Islamic jurist of OIC) এর ঐক্যমতের ভিত্তিতে মিল্ক ব্যাংককে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।বাংলাদেশের কিছু ইসলামি সংগঠন ও ব্যক্তি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংককে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে মিল্ক ব্যাংক থেকে দুধ পান করা বা এ ধরণের মিল্ক ব্যাংক স্থাপন করা হারাম বলে দাবি করেছে।
ইতোমধ্যে মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণে মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের বিরুদ্ধে যথাযথ শর্ত আরোপ চেয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্কানো), নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসসকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তাদের দাবি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক শরিয়াসম্মত নয়।নোটিশে বলা হয়েছে, ‘মিল্ক ব্যাংক ইস্যুতে আইনগত ও ধর্মীয় সমস্যা রয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, কোনও শিশু কোনও নারীর দুধ পান করলে ওই নারী ওই শিশুর দুধমাতা হয়ে যান। বাংলাদেশে ওই মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের ফলে একই মায়ের দুধ পানের কারণে যারা দুধ পান করবে, তারা প্রত্যেকে ভাই-বোন হয়ে যাবে। তাই ভবিষ্যতে এসব ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হলে সেটি ইসলাম ধর্মবিরোধী হয়ে যাবে।তাদের মতে মিল্ক ব্যাংক ১৯৩৭ সালের মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।
শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ) কিছু যুক্তি তুলে ধরে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।তারা আলেমদের যুক্তি খন্ড করে তাদের কিছু সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছেন। তাদের মতে মুসলিম দেশ কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তানে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে। মালয়েশিয়ায় তাদের স্লোগানই হচ্ছে, হিউম্যান মিল্ক ফর হিউম্যান বেবি। তাদের যুক্তি ইরান, কুয়েত, মালয়েশিয়া যদি করতে পারে, আমরা কেন পারবো না? বাইরের কথা যদি বাদও দেই, এই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে যেসব বাচ্চারা থাকে, যেসব বাচ্চার দত্তক নেওয়া হয়, তাদের সাহায্য করার জন্যও ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ)এর দাবি দুধ সম্পর্কের যে কথা বলছেন সে আশঙ্কা নেই৷ বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই তারা এটা স্থাপন করেছেন৷ এখানে যে মা দুধ দেবেন তার প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে৷ তাকে আইডি কার্ড দেয়া হবে৷ সংরক্ষিত দুধ যে শিশুকে দেয়া হবে তার পরিচিতি সংরক্ষণ করা হবে৷ তাকেও কার্ড দেয়া হবে৷ রেফারেন্স নম্বর-রেজিস্ট্রেশন নম্বর, খাতা ও ভলিউম, এন্ট্রি পৃষ্ঠার নম্বর, সবই তাদের দেওয়া হবে। একজন মায়ের দুধের সঙ্গে আরেকজন মায়ের দুধ মিশে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই আর সবচেয়ে বড় কথা হলো যে মায়ের ছেলে সন্তান তার দুধ ছেলে শিশুকে দেয়া হবে৷ আর যে মায়ের মেয়ে শিশু তার দুধ মেয়ে শিশুকে দেয়া হবে৷ আর দুধ দানের ব্যাপারে মা এবং তার স্বামীর লিখিত সম্মতি নেয়া হবে৷ ধর্মীয় কারণে এইসব তথ্য দেশের কাজি অফিসগুলোতেও পাঠানো হবে৷তারা আরো জানান বাইরের দেশে একাধিক মায়ের বুকের দুধ একসঙ্গে রাখা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে এটা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে আলাদা করে রাখা হবে। এ কারণে তারা ছক করে পাস্তুরিত মেশিন তৈরি করেছেন, যেখানে প্রত্যেক মায়ের বুকের দুধ আলাদা কৌটায় রাখা যাবে।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ উদ্যোক্তরা আরও বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা ইতোমধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আবেদন করেছেন। শুরুতে তারা দ্বিধায় থাকলেও পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর সেই সন্দেহ দূর হয়েছে বলে তাদের দাবি।তাদের। মতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তারা নিজেরা কর্মশালা করে শিগগিরই তাদের জানাবেন।
এদিকে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পক্ষে কিছু আলেম অভিমত দিয়েছেন। তারা বলেন জবাবদিহিতা ও স্বচছতা নিশ্চিত করা গেলে এটি চালু করা যেতে পারে। তারা বলেন,আমাদের নবীজীও দুধ মায়ের দুধ পান করেছেন৷ তার একজন নয় একাধিক দুধ মা ছিলেন৷ তারা বলেন, উদ্যোক্তাদের উচিত হবে আলেমদের নিয়ে বসা। পুরো বিষয়টি আলেমদের ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা। আর ভালো কাজে কেউ বাধা দেবে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তারা বলেন আলেমদের নিয়ে বসুন। তাদের বুঝিয়ে বলুন।তারা বলেন, মুসলিম দেশ কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান যে পদ্ধতি অনুসরণ করে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, আমাদের দেশেও সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যাবে না কেন?মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যে পদ্ধতিতে দুধদাতা গ্রহণকারীদের প্রত্যেককে যেভাবে আলাদা আইডিকার্ড দেবে, তাতে তাদের সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য থাকবে উদ্যোক্তাদের কাছে। একজন মেয়ে শিশুর মা একজন মেয়ে শিশুকে এবং একজন ছেলে শিশুর মা ছেলে শিশুকেই দুধ দেবেন।তাদের মতে যদি এমন পদ্ধতিতে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দুধ ভাই-বোনের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনও জটিলতা হবে না। কারণ, বিয়ের আগে সংশ্লিষ্টরা খোঁজ নেবেন, তারা এতিম ছিলেন কি না, তারা মিল্ক ব্যাংক থেকে দুধ গ্রহণ করেছেন কিনা। তখন তাদের সম্পর্কিত তথ্য যাচাই করলেই বিষয়টি ধরা পড়বে। প্রকৃত তথ্যও জানা যাবে। ফলে যারা দুধ ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা করছেন, তারা ভুল করছেন। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হতে পারে। তবে, যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান আছে, সেহেতু কর্তৃপক্ষের উচিত হবে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া।
তবে যাই বলা হোক না কেন। বিষয়টি আরো আলোচনা ও গবেষণা প্রয়োজন। খুঁটিনাটি বিষয় গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। বর্তমানে আইসিএমএইচ যেই ধারায় উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে, এতে সংকট নিরসনের চেয়ে জটিলতা আরো বাড়বে।আমরা আগেই জেনেছি ওআইসির ফতোয়া অনুসারে মিল্ক ব্যাংকে দুধ দান করা, মিল্কব্যাংক থেকে দুধ পান করা এবং মিল্কব্যাংক স্থাপন করা সবই হারাম।
অনেকে একে ইসলাম ও ঈমান বিধ্বংসী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। কেননা ইসলামি শরিয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে হিফযুন নসল বা বংশীয় সম্পর্কের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মিল্ক ব্যাংক এই ধারাকে ধ্বংস করবে। সমাজে অপরিচিত অনেক দুধ ভাই-বোনের জন্ম হবে, যাদের সংখ্যা আদৌ নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অজ্ঞাতসারে দুধ ভাই-বোনের মধ্যে যে হারাম বিয়েগুলো সম্পাদিত হবে, তার দায়-দায়িত্ব কে নেবেন?কর্তৃপক্ষ যে বিষয়গুলো পরিপালনের কথা বলেছেন তা জটিল ও দীর্ঘ মেয়াদি। এসব তদারকি করা কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার বটে। এক সময় এই প্রক্রিয়া হযবরল হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইসলামি মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন সংরক্ষণে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক চ্যালেঞ্জিং হবে।কিছু নারী নিজের স্বাস্থ্য ও শারীরিক গঠন ঠিক রাখার অজুহাতে নিজের সন্তানকে দুধ পান না করিয়ে মিল্ক ব্যাংকের শরনাপন্ন হতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক