রাজাকারদের তালিকা নিয়ে কেন এতো বিতর্ক?

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশে বিজয়ের ৪৮ তম বর্ষে এসে রাষ্ট্রের খামখেয়ালিপনা ও দায়িত্বহীনতায় প্রণীত রাজাকারদের তালিকায় যখন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, তখন নতুন করে এ রাষ্ট্রের দিকপাল ও নীতি নির্ধারকদের নিয়ে ভাবতে হয়।তাদের দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।

এদেশের কুখ্যাত কুলাঙ্গার রাজাকারদের নামের সঙ্গে যখন জীবিত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন বড্ড বেশি বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।যাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের এই দেশ, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর কাছাকাছি এসে তাদের দেখতে হলো রাজাকারদের তালিকায় নিজেদের নাম। এর চেয়ে কষ্টের, এর চেয়ে নির্মম উপলব্ধি আর কি হতে পারে? স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি বর্তমান সরকারের জন্য বিষয়টি বিব্রতকর হলেও সরকার কতটুকু বিব্রত তা বলা মুশকিল। যখন দেখি সরকারের দুটো মন্ত্রণালয় পরস্পরকে দোষারোপে ব্যস্ত তখন বিষয়টি হালকা রসবোধের জন্ম দিয়েছে বৈকি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে বিজয় দিবসের আগের দিন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে । এদিকে স্বাধীনতার পর গত ৪৮ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু এবার রাজাকারদের তালিকার শুরুতে এতোটা গলদ ও বিতর্ক তা যে সহজে শেষ হবেনা তা নিশ্চিন্তে বলা যায়।

অবশেষে রাজাকারদের বিতর্কিত তালিকা সরকার স্থগিত করেছে। আগামী বছরের মার্চ মাসে নতুন তালিকা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। তবে সত্যিকারের রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নে সদিচ্ছার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজাকারদের তালিকায় নাম এসেছে সাবেক প্যানেল স্পিকার, বঙ্গবন্ধুর বেয়াই ও সহচর থেকে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির নাম।

প্রকাশিত রাজাকারের তালিকার বরিশাল বিভাগের তালিকার ২০ নম্বর পৃষ্ঠার ৫৮ নম্বর সিরিয়ালে নাম এসেছে আবদুল হাই সেরনিয়াবাতের। তিনি বঙ্গবন্ধুর বেয়াই ছিলেন। ১৫ আগস্ট শহীদ হন। তাঁর নাম দেখে অবাক হয়েছেন অনেকে। আবদুল হাই সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুর বোন আমিনা বেগমের স্বামী সাবেক কৃষিমন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাই। জানা যায় আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত ১৯৭১ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেসময় তার বয়স ৬০ এর ওপরে থাকলেও স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন দেশের। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বন্দুকটি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেন।

সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক প্যানেল স্পিকার ছিলেন প্রয়াত মির্জা আব্দুল লতিফ। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের কিংবদন্তি ও লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। লতিফ মির্জা নামেই তিনি সব মহলে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন তিনি। অথচ সেই লতিফ মির্জার নাম এসেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘোষিত রাজাকারের তালিকায়। প্রকাশিত সিরাজগঞ্জের ৭২ জন রাজাকারের তালিকার মধ্যে রয়েছে মির্জা আব্দুল লতিফ ও বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলমের নাম। রাজশাহী বিভাগের ৩৪ নম্বর ক্রমিকে এ দুইজনের নাম রয়েছে।

প্রকাশিত তালিকায় নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর নাম নিয়ে। টিপু একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা আন্দোলন কর্মী। ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলন মূলত তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে। তালিকায় গোলাম আরিফ টিপুর নাম আছে কিন্তু তার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। তালিকায় নাম থাকা নিয়ে টিপু বলেন, ‘‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এই তালিকা দেখে বিস্মিত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে যারা রাজাকার, আল-বদরের তালিকায় অর্ন্তক্ত করেছে, সেটা কিভাবে হলো এবং কারা এটা করেছে -এটা খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’’

তালিকায় রয়েছে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের তৎকালীন পাথরঘাটা থানার আহ্বায়ক মো. মজিবুল হকের নামও। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য। ১৯৭০ সালে পাথরঘাটা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। মুজিবুল হক ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন এই দায়িত্বে।এছাড়া, ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাথরঘাটা-বামনা সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতিবীদ হিসেবে পরিচিত এই মানুষটি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর, ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তাঁর নাম আসায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বরগুনা জেলার মানুষ।

রাজাকারের তালিকায় নাম এসেছে বরিশালের গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তীর। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ৯ নম্বর সেক্টরের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল জেলায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধাতের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম দেখে হতাশা ব্যক্ত করেন অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী। "স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকায় আমার এবং আমার মা ঊষা রানী চক্রবর্তীর নাম এসেছে। এতে আমি খুবই মর্মাহত এবং কিছু বলার নেই। এটা দেখার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল।"তাঁর বাবা সুধীর কুমার চক্রবর্ত্তীকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১২ আগস্ট ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়ে ওয়াপদা বধ্যভূমিতে হত্যা করে। পরিবারকে তার লাশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরে রাষ্ট্র সুধীর চক্রবর্ত্তীকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়।

তবে এই তালিকা নিয়ে বচসা শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেন, ‘‘তালিকা আমরা প্রণয়ন করি নাই। প্রকাশ করেছি।যে তালিকা আমরা পেয়েছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে, তার দাড়ি কমা সেমিকোলন - কিছুই আমরা পরিবর্তন করি নাই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী যেভাবে তালিকা করেছিল, সেটাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের দিলে আমরা সেটাই প্রকাশ করেছি।’’এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দালাল আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাদের তালিকায় তারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের মামলা প্রত্যাহার হওয়ার ব্যাপারে নথিতে থাকা ব্যাখ্যা প্রকাশ না করায় এখন বিভ্রান্তি হচ্ছে।’’

এ ব্যাপারে যে যাই বলুন না কেন রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে সরকারি দপ্তর গুলোর সমন্বয়হীনতা ও আন্তরিকতার যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে তা প্রতীয়মান। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এই তালিকা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন হলো সরকার কোনো রকমের যাচাই বাছাই ছাড়া এ তালিকা কিভাবে প্রকাশ করলো? এই তালিকা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তবে কি রাজাকারদের তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলো? উত্তর হ্যাঁ। এরপর হয়তো সাধারণ মানুষ যে মুক্তিযুদ্ধ করেনি তার নাম তালিকায় আসবে।এ নিয়ে কিছুদিন বিতর্ক চলবে। ক্ষমা চাইলে সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হৃদয়ে কষ্টের যে ছাপ সেটি কি মুছে যাবে?

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ