সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে ঢাবিকে ভার মুক্ত করুন

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ঢাবি। বিশ্বের ইতিহাসে ঢাবি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যার রয়েছে একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাস। যা অন্য দেশে নেই। এদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ যেকোনো আন্দোলনে ঢাবি ছিল নেতৃত্বের আসনে।

পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচার আইয়ুব খান থেকে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে এমনকি নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ঢাবিকে তারা তাদের ক্ষমতা অনুশীলন ও প্রভাবের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। যার ফলে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ। ঝরেছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। সেই ঢাবিকে নিয়ে কম ষড়যন্ত্র হয়নি, এখনো হচ্ছে। প্রত্যেক সামরিক স্বৈরাচারী সরকার এমনকি নির্বাচিত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত করে দখলদারিত্ব কায়েমের চেষ্টা করেছে।

অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। আবার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে লেজ গুটাতে বাধ্য হয়েছে। ঢাবির শিক্ষার্থীদের সেই বিবেকবোধ, অবদান, সচেতনতা এখন শুধু মুখরোচক গল্পে পরিণত হয়ে আছে।

একসময় বাংলাদেশে স্নাতক পড়ানো হয়— এমন কলেজগুলো কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এসব অধিভুক্ত কলেজের তদারকি করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনায় বাড়তি চাপ অনুভব করছিল। সেই চাপ কমাতে ও অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নে লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ পার্লামেন্ট ৩৭নং আইন পাশ করে।

এই আইনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সেইসব কলেজ অধিভুক্তকরণ, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, জ্ঞান উন্নয়ন ও বিতরণের কাজে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি, পরীক্ষার আয়োজন ও ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশে স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই হাজারের বেশি কলেজে পড়াশুনা করছে।

সাত কলেজ ঢাবিতে অধিভুক্ত হবার সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ২১ লাখ। সরকারি প্রায় ২০০ ও বেসরকারি প্রায় ৫০০ কলেজে স্নাতক (সম্মান) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। ২০১৪ সালের ৩১ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এমন সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। এ বিষয়ে ইউজিসি পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

যে কারণে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী ঢাকার সাত সরকারি কলেজ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ আলাদা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। অধিভুক্তির সময়ে এসব কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী ও ১ হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন।

সাতটি কলেজ ঢাবির অধিভুক্ত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ তৈরি করে। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্তমানে প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট এবং ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একই প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা সম্পন্ন করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ঢাবিসহ অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের।

এছাড়া ঢাবির শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট যেখানে চরম পর্যায়ে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা যেখানে নেই বললেই চলে, যেখানে শিক্ষার মান দিন দিন শিটনির্ভর, শিক্ষার্থীর সেমিস্টার ফাইনালের অ্যাডমিট কার্ড উত্তোলন করতেই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সেখানে নিত্য-নতুন সান্ধ্যকালীন কোর্স, হোম ইকোনমিক্স কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার সাত কলেজকে ঢাবিতে অধিভুক্ত করা ছিল অযৌক্তিক অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষাগত এবং পরিবেশগত মানোন্নয়নে নজর না দিয়ে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার কারণে ঢাবি বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও স্থান পাচ্ছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার রয়েছে প্রচলিত কাহিনী। যদিও এর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের বড় ভূমিকা ছিল। সেই সময় আরেফিন সিদ্দিক এবং অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছিল বলে জানা যায়।

তাই অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের উপর প্রতিশোধ নিতে আরেফিন সিদ্দিক সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নেন। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের উৎসও বেশ কমে আসে।

ঢাবির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সাত কলেজের অধিভুক্তি দ্রুত বাতিল করা সময়ের দাবি। আগে কলেজ শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়ন করলেও অধিভুক্ত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখেন। যা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফল বিপর্যয় ডেকে আনে।

সাত কলেজ অধিভুক্তির কারণে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি ঢাবির শিক্ষার্থীরাও কম ক্ষতিগ্রস্ত হননি। ঢাবির শিক্ষকরা এমনিতে বাইরের কার্যক্রম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা একাডেমিক কাজে সবাই খুব বেশি নিবিড় এমনটা নয়।

অন্যদিকে শুরুতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাবি অধিভুক্তি ছিল সুখের খবর। কিন্তু এখন তাদের সেই সুখ স্বপ্নের মোহ ভঙ্গ হয়েছে। তারা পরিত্রাণ চায়। তাদের শিক্ষা জীবন এখন হযবরল অবস্থা। অব্যবস্থাপনা অনিয়ম, সেশন জটের কারণে তারা বিরক্ত ও রুষ্ট।

এরমধ্যে বদরুননেসা কলেজের এক ছাত্রীর মৃত্যু তাদের ঢাবির শৃঙ্খল হতে মুক্ত হতে আরো বেশি অস্থির করে তুলছে। এজন্য তারা ঢাবির নাগপাশ থেকে ছিন্ন হয়ে আলাদা প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে পরীক্ষা তদারকির দাবি করছে।

তারা নতুন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে জুনিয়র হতে চায় না। এদিকে ঢাবি ও নিজেদেরর আইডেন্টিটি রক্ষায় ঢাবির শিক্ষার্থীরাও বসে নেই। সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের এক দফা দাবিতে তারাও লাগাতার আন্দোলনে রয়েছে। ঢাবির নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রক্ষায় সাত কলেজের অধিভুক্ত বাতিলের বিকল্প পথ খোলা নেই।

সব মিলিয়ে বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। তবে আশা করি ঢাবি কারো হাতের খেলনা না হয়ে এ দুঃসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। সাত কলেজ থেকে ভার মুক্ত হয়ে জাতি গঠনে সঠিক ভূমিকা পালন করবে।

[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]


সর্বশেষ সংবাদ