রিফাত মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, স্ত্রী মিন্নি প্রতিদিন মরবে
- ওয়ারিশ আজাদ চৌধুরী
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০১৯, ০৫:০৩ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:১১ PM
রিফাত হত্যাকান্ড নিয়ে কিছু লিখলে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়না। মানুষ হিসেবে আমরা খুব অস্থির হিংস্র প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছি। রিফাতকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। তার স্ত্রী বাঁচানোর চেষ্টা করেছে অনেক। আপনার ভালোবাসার মানুষকে কেউ হত্যা করছে আপনার সামনে। একজন স্ত্রীর জন্য এর চাইতে নিষ্ঠুর কিছু হতে পারে না।
আমি বলি রিফাত মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। তার স্ত্রী আজ থেকে জীবনের বাকি দিনগুলোতে প্রতিদিন মরবে, প্রতি রাতে মরবে, প্রতি মিনিটে মরবে, প্রতি সেকেন্ডে মরবে। আমি আশা করি প্রয়োজনীয় মানসিক সাপোর্ট সে তার আপনজনদের কাছে পাবে।
আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লেগেছে। খুনের মোটিভটা। প্রেমের জের ধরে নাকি। এক ছেলে পছন্দ করত সেই হত্যাটা করেছে। ভালোবাসলে কি করে কেউ কাউকে হত্যা করতে পারে? যে ভালোবাসতে পারে তার দ্বারা কিভাবে হত্যার মত অপরাধ সংঘটিত হয়। আমি খুনির মনস্বত্ব বোঝার চেষ্টা করছি।
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন? ভাই বিচার চান। বিচার দরকার। দেখেন জাস্টিস ইজ পার্ট অফ দা প্রসেস। যদি পুরো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি তাহলে সেখানে বিচার হলো গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। আরো একটা অংশ হলো মানুষ হিসেবে আমাদের মানসিক বিবর্তন এবং দিন দিন হিংস্র হয়ে যাওয়া। আমরা অতি সামান্য কারণে খুন করতে শিখে গেছি।
হিংস্র, ক্রুল মাইন্ড, ভায়োলেন্ট বিহেভিয়ারকে এক শব্দে বলে Wrath। এটি সেভেন ডেডলি সিনসের একটা। যে সাতটি পাপ কে ফাদার্স অফ অল সিন বলে।
আরেকটা প্রশ্ন উঠতে পারে। এত মানুষ ভিডিও করল কেউ রিফাত কে বাঁচাতে গেলোনা। এই প্রশ্ন আমি করতে পারি মুখের উপর। উল্টা প্রশ্ন যদি আসে, মিয়া আপনি থাকলে আপনি কি যেতেন?
ইন্ডিয়াতে সেদিন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাবরেজকে পিটিয়ে হত্যা করল। তাকে বাধ্য করল জয় শ্রী-রাম, জয় হনুমান বলতে। জয় শ্রী-রাম তাবরেজ বলেছিলো। তাতে রামের কি লংকা উদ্ধার হয়ে গেছে? হয়নি। কিন্তু তাবরেজকে পিটানো মানুষগুলোর মনের যে Wrath সে রেথের ক্ষুধা মেটানো গেছে।
এই উপমহাদেশের মানুষগুলো আগে কম জানত, কম চিনত আমার মনে হয় মানুষ হিসেবেও আমরা আগে ভাল ছিলাম। তাবরেজকে যখন পিটিয়ে মারা হচ্ছিলো, তখনো কিন্তু সেখানে কোন সেক্যুলার হিন্দু এগিয়ে আসেনি তাকে বাঁচাতে।
অতি ধার্মিকতার অপর নাম হিংস্রতা। এই ধর্মের জয়ের জন্য লাখ লাখ মানুষ ক্রুসেডে মারা গিয়েছিলো। সবার রক্তের রং-ই লাল ছিলো। এমন না মুসলিমদের রক্ত নীল আর ক্রিস্টানদের রক্ত সবুজ ছিলো। দিনের শেষে জয় হয়েছিলো কার, দা ফাদার অফ অল সিন Wrath এর।
তাবরেজেরটা ছিলো রিলিজিয়াসলি মোটিভেটেড ক্রাইম। আর রিফাতেরটা পার্সোনালি মোটিভেটেড ক্রাইম। হিংস্রতার কারণ ভিন্ন, ধরণ একই। প্রাণ গিয়েছে মানুষের গিয়েছে।
রিফাত হত্যার বিচার চাই। তার স্ত্রীর এটা প্রাপ্য। ওই মেয়েটার বেঁচে থাকার কারণ একটাই। হাজব্যান্ড হত্যার জাস্টিস আদায় করার। তার জন্য যেন মেয়েটাকে থানায় থানায়, কোর্টে কোর্টে, অফিসে অফিসে বেশী দৌড়াতে না হয়। আমরা যেন এক বছর পরে না দেখি খুনিরা জামিনে বাদাম চাবায় বেড়াচ্ছে। যদি সেটা হয় তাহলে বুঝে নেবো, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা, Damned beyond saving.
ইতালিয়ান কবি দান্তের ডিভাইন কমেডিতে রেথকে বলা হয়েছে ফিফথ ডেডলি সিন হিসেবে। সকল যুদ্ধ, সকল ভায়োলেন্সের উৎস হলো রেথ। কখনো কখনো হিংসা বা এনভি।
রিফাতকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো, বিশ্বজিতকেও প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিলো। তাবরেজকেও প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো। হাজার হাজার হত্যা গোপনে হচ্ছে। হত্যার ধরণ, হত্যার মোটিভেও বিবর্তন হচ্ছে। আমরা সামান্য কারণে মানুষ হত্যা শিখছি। ধর্মের কারণে, হিংসার কারণে, বৈষয়িক বিভিন্ন কারণে। সামনে এমন দিন আসবে একটা রুটি ভাগাভাগি নিয়ে খুনোখুনি হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হত্যা একটি কমন ওয়ার্ড হবে।
আনলেস, আমরা যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসা শিখছি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা শিখছি। আমাদের অহংকার, আমাদের হিংসা, আমাদের রেথকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখছি। আপনি এসব সমস্যার লংটাইম সমাধান চান? আপনি চান আর কোন রিফাতকে যেন এভাবে মরতে না হয়।
তাহলে মানুষ হিসেবে আমাদেরকে একটি শব্দকে আকড়ে ধরতে হবে। সেটি হলো এমপ্যাথি। সহানুভূতি। আপনার সন্তানকে জীবনে সফল হওয়ার মন্ত্র শেখানোর আগে মানুষের প্রতি সহানুভূতি আনার মন্ত্র শেখান। নাহলে আপনার সন্তান ঘুষ খেয়ে সফল হবে, খুন করে সফল হবে।
এমপ্যাথি একমাত্র এমপ্যাথিই পারে মানুষের মাঝে শান্তি ফেরাতে। আর যদি আমরা আমাদের হৃদয়ের হিংস্রতাকে দমন করতে না পারি তাহলে এইটা মেনে নেন, ম্যানকাইন্ড ইজ ডুমড বিয়ন্ড সেভিং।
[লেখক: ফ্যাশন ব্লগার এবং সামাজিক কর্মী]