জন্মান্ধ হাবিবের ভবিষ্যত এখন ঘোর অন্ধকারে

জীবনের শুরু থেকেই নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন জন্মান্ধ হাবিবুর রহমান হাবিব। কম্পিউটার ট্রেনিং, কল সেন্টার ট্রেনিং সবই করা আছে তার, শুধু নাই কাজ করার সুযোগ। তাঁর সংগ্রামী এই জীবনের গল্প নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাঁরই বন্ধু  আনামুল হাসান। নিচে তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

মেহেরপুর সদরের প্রত্যন্ত এক গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারে আমার বন্ধু হাবিবুর রহমান হাবিবের জন্ম। জন্মের পর সূর্যের আলো তার চোখে পড়লেও পৃথিবীর আলো সে কোনদিন দেখেনি। জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম। হতদরিদ্র পরিবার, অভাবের সংসারে থাকা হয়নি খুব বেশি দিন। খুলনায় প্রতিবন্ধীদের স্কুলে পড়ালেখায় হাতেখড়ি। তুখোড় মেধাবী হাবিব চোখের আলো না পেলেও জ্ঞানের আলোয় দেখতে থাকেন পৃথিবীকে।

প্রতিবন্ধী মানে ‘ডিজেবল নয় বরং ডিফরেন্টলি এবল’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ডিঙ্গাতে থাকে বাঁধার পাহাড়গুলো। একসময় সফলতা এসে ধরা দেয় তার কাছে। হাজারো মেধাবীকে পেছনে ফেলে ২০১০-১১ সেশনে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাস্টার দা সূর্যসেন হলের ১৬২ নম্বর কক্ষ হয় তার নতুন স্বপ্নের ঠিকানা। অতীতের কষ্টগুলো ঢেকে যায় ভবিষ্যতের সুন্দর আশায়। বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির টাকায় অভাবও কিছুটা পিছু হটে। দুর্বার গতিতে হাবিব এগিয়ে যায় নতুন স্বপ্নের দিকে।

৩৭ তম বিসিএসে আমরা কেউ না টিকলেও টিকে যায় মোটেও চোখে না দেখা বন্ধু হাবিব। প্রিলিঃ, রিটেন, ভাইভা অবধি চলতে থাকে তার অগ্রযাত্রা। নন ক্যাডারে নাম আসে, কিন্তু চাকরি নামক জীবন বাঁচানোর একটি অবলম্বন হাবিবের হাতে ধরা দেয় নি এখনো। পড়াশোনা শেষ তাই বৃত্তির টাকা আসা বন্ধ। হলে থাকারও সুযোগ নেই। হাবিব চলে আসে মিরপুরে এক জনাজীর্ণ মেসে। দরিদ্র পরিবার থেকে টাকা আনার উপায় নেই, তাহলে জীবন চলবে কিভাবে?

হাবিব বেছে নেয় এক কঠিন পথ। রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে ঔষধ বিক্রি করে। ২/৩ শ যা আয় হয় তা দিয়েই নিজ হাতে রান্না করে খায়। হলে থাকতে যে বন্ধুদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো হাবিবের রুম তারাও সবাই জীবন যুদ্ধে নেমে হাবিবের কথা প্রায় ভুলে যায়। একাকি চলে হাবিবের জীবন। কখনো প্রতিবন্ধী স্কুলে, কখনো মেসে। সর্বশেষ তার ঠিকানা ছিলো টঙ্গীতে প্রতিবন্ধীদের ট্রেনিং ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কম্পিউটার ট্রেনিং, কল সেন্টার ট্রেনিং সবই করা আছে তার, শুধু নাই কাজ করার সুযোগ। এরই মধ্যে নানা রকম রোগে ভোগে ঔষধ কিনতে না পারা আমার বন্ধু হাবিব। তার এখনো স্বপ্ন, বিসিএস নন ক্যাডারে তার কিছু হবে। হোক না জন্মান্ধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী নিজ যোগ্যতায় কিছু করে খাবে এটাই তার চাওয়া।

এদিকে ট্রেনিং সেন্টারে থাকার মেয়াদও শেষ। তাই জিনিসপত্র নিয়ে গতকাল সকালে বাড়ি যাওয়ার জন্য টঙ্গী স্টেশন রোডে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বার বার হাত দিয়ে দেখছিলো ঠিক আছে কি না সবকিছু। ঠিকই ছিলো, হঠাৎ করে দেখে তার ট্রাংকটি নেই। নিয়ে গেছে কোন চোর, ছিনতাইকারী বা গাজাখোর। যেটিতে ছিলো তার সারা জীবনের অর্জন। সকল সার্টিফিকেট, একটি মোবাইল ও দুই হাজার টাকাসহ আরও কিছু জিনিস।

সারাজীবন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে দিতে পোড় খাওয়া হাবিবকে সৃষ্টিকর্তা আবারও ফেললেন কঠিন পরীক্ষায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হাবিব ছুটে গেলেন টঙ্গী থানায়। পুলিশ নাম, মোবাইল নাম্বার রেখে বলে দিয়েছে জিনিসপত্র পেলে তারা হাবিবকে জানাবে। হাবিব চলে গেছে বাড়িতে। আজ বিকালে ফোনে কথাগুলো বললো। কি বলে সান্ত্বনা দিবো ভেবে পেলাম না। তাই মনের কথাগুলো সবার সাথে শেয়ার করার জন্য লিখলাম। বিধাতার কাছে আর কত পরীক্ষা দিবে আমার বন্ধু হাবিব?

বিসিএসে উত্তীর্ণ একজন অন্ধকে ন্যূনতম পদের একটি চাকরিও কি দিতে পারেনা পিএসসি? অথবা অন্যকোন সংস্থা, অফিসেও কি জোটেনা একটি চাকরি? যার বেতনে জীবন ধারণ করবে একজন অন্ধ মানুষ। এখন কেউ চাকরি দিতে চাইলেও পাবে কিভাবে? তার সমস্ত কাগজপত্র তো এখন চোরের হাতে। কোন আলোর পথ কি আছে হাবিবের জন্য? নাকি অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে চোখের আলো হারানো হাবিবের ভবিষ্যত?


সর্বশেষ সংবাদ