রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিহিংসার রাজনীতি

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সম্মানজনকও। গত কয়েকদিন ধরে সম্মানজনক এই পদটি নিয়ে নানা মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা থেকে শুরু করে সু-উক্তি, কটূক্তি কোনো কিছুই আর বাদ যায়নি। তাই নিজে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

যদিও বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। আবার এটিও সত্য যে, প্রতিটি প্রশাসনের চাটুকারদের তেলেছমাতিতে সমাজে বিচ্চূর্ণ এক মানুষ আমি। এর মধ্যেও আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’-এর মধ্যে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। উক্ত বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর এই জন্য বলছি- কেননা মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। একই সাথে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭৩-এর এ্যাক্ট এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়ে আসছে।

এই আইনেই দেখা যায় মাননীয় উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে কে কে দায়িত্ব পালন করতে পারেন? প্রথমত: উপ-উপাচার্য এবং তার অনুপস্থিতিতে কোষাধ্যক্ষ যদি কোষাধ্যক্ষও না থাকেন তবে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন (পূর্বে কলা অনুষদের ডিন ছিল)। যেহেতু উক্ত সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ দুটি শূন্য ছিলো, তাই বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন এটাই নিয়ম। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেমন অযৌক্তিক তেমনি বোকামিও বটে!

সংবাদ মাধ্যমে খবরের শিরোনাম- ‘প্রতারণা করে বিভাগ থেকে অবসর, রাবি উপাচার্যের পদে থাকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ’। এখানে ‘প্রতারণা’ শব্দটির ব্যবহার যেমন ভয়ংকর তেমনি আপত্তিকরও বটে। কেননা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যকে নিয়ে এ ধরণের বাক্যের ব্যবহার দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। অন্যদিকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দেওয়া নিয়োগকে যে আইন বিশারদ চ্যালেঞ্জ করছেন, এটিও যে আইন লঙ্ঘনের শামিল এই ধারণাটিও তার থাকা দরকার। কেননা একটি দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের সকল আইনের ঊর্ধ্বে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করাও আইন সম্মত হয় না। উক্ত বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে লিগ্যাল নোটিসটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন যেমন আসবে তেমনি মানহানিকর বিষয় উপস্থাপনের জন্য আইন তার বিরুদ্ধেও যেতে পারে।

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-এর মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানকে আগামী চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। উক্ত সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর বিভাগের অধ্যাপক-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করলেও উপাচার্য পদ থেকে কিন্তু পদত্যাগ করেননি। বরং বলা যায়- যে সময়ের জন্য তিনি অধ্যাপক এর দায়িত্ব থেকে অবসর নেন উক্ত সময়ে নিয়মানুযায়ী অন্যের উপর উপাচার্যের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব দিয়েছেন। আরও উল্লেখ্য যে, অবসর গ্রহণ পূর্বক উপাচার্যের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমতি পার্থনা করেন এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিষয়টির অনুমোদনও দিয়েছেন। যার যথেষ্ট প্রমাণাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নিকট রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়- ‘২০১৭ সালের ৭ মে চার বছরের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। ওই দিনই তিনি উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু আচার্যের পূর্বানুমতি না নিয়ে ওই বছরের ২১ জুন পূর্বাহ্ণে উপাচার্যের পদে থেকে নিজ বিভাগে অর্থাৎ ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। ওই দিন অপরাহ্ণে উক্ত পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন তিনি। এ কারণে ওই বছরের ২১ জুন পূর্বাহ্ণ থেকে অপরাহ্ণ পর্যন্ত উপাচার্যের পদে সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। উপাচার্যের পদের সাময়িক শূন্যতা পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান শুধু একদিনের জন্য (২১-০৬-২০১৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড আখতার ফারুক দায়িত্ব প্রদান করেন, যা সম্পূর্ণ বে-আইনি ও নীতির বিরোধী।’

এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারী দ্বারা কিন্তু রাষ্ট্রপতি পরিচালিত হয় না বরং মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্বারা বাংলাদেশের আইন পরিচালিত হয়। সুতরাং উক্ত সংবাদটি যে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত, তা সহজেই প্রতীয়মান হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ পূর্বক উপাচার্যের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে রাষ্ট্রপতির অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাই এটিও সত্য যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন চলতি দায়িত্ব পালনে অনুমতি প্রদান করেছেন তখন উপাচার্যের পদটি কোনো ভাবেই বে-আইনী হয় না। বরং যে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে রম্য-রচনায় শামিল হয়েছেন, তাদের এই হীন কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। তাদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক এমনটিই প্রত্যাশা।

এখানে এটিও উল্লেখ করছি যে, বর্তমান মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ-এর রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন বলেই ১/১১ মতো দুঃসময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং জেল-জুলুম ও নানা রকম অত্যাচারও সহ্য করেছিলেন। তবুও সেনা পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। আওয়ামীলীগের যে কোন সংকটকালেও তিনি দৃঢ়চিত্তে সত্য উচ্চারণ করেছেন এবং দলীয় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য সর্বদাই রেখে চলেছেন। দলীয় বিভিন্ন তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি দলের একজন পরীক্ষিত, বিশ্বস্ত এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে পুনরায় নিয়োগ পেয়ে যথাযথ মূল্যায়িত হয়েছেন।

বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ও বাইরে ক্ষমতালোভী কিছু কুচক্রীমহলের যোগসাজশে অনৈতিক এ সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চাই- ষড়যন্ত্র করে আপনাদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে কি? তাই বলছি- ভালো শিক্ষক, আইন বিশারদ, সাংবাদিক বা ভালো ছাত্র হওয়ার আগে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা বেশী প্রয়োজন। বর্তমান মাননীয় উপাচার্য ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বর্তমান সময়ের মানুষ স্বার্থপরতার সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেছে। সেই স্বার্থপরতা থেকে বের হয়ে তোমাদের দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে হবে। এ জন্য ভাল ছাত্র হওয়ার আগে ভাল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।’ সুতরাং বর্তমান মাননীয় উপাচার্য যে, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব এতে কোন সন্দেহ নেই।

বর্তমান মাননীয় উপাচার্য অনেক ধৈর্যশীল, কেননা কিছুদিন আগেও যারা বর্তমান উপাচার্যের নিজ সন্তানকে চাকুরীচ্যুত করেছিলেন, তাদের প্রতি তিনি বিন্দুমাত্র প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। তবে এটিও সত্য যে, চাটুকার ও ক্ষমতালোভীরা অনেক ধূর্ত এবং ভয়ংকর চতুর। আর বর্তমান প্রশাসনেও চাটুকারদের দৌড়াত্ব চোখে পড়ার মতো। প্রকৃত দুঃসময়ের মানুষগুলোও এখন চাটুকারদের ভীড়ে দূরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আবার অন্যদিকে চাটুকাররা তোতা পাখীর মতো সর্বময় সুবিধা নিয়েই চলেছে কিন্তু দুঃসময়ের ত্যাগী মানুষগুলো বর্তমানেও উপেক্ষিত হয়েই চলেছে। আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করবেন এবং আরও সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, রাবি
সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, রাজশাহী জেলা শাখা।


সর্বশেষ সংবাদ