ফ্যাসিস্ট: একাল-সেকাল
- খালিদ মাহমুদ পলাশ
- প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৭ PM , আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২০ PM
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একটি আলোচিত শব্দ ফ্যাসিজম। যারা ফ্যাসিজম কায়েম করে তাদের বলা হয় ফ্যাসিস্ট। এই ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে যারা কুখ্যাত তাদের মধ্যে জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনি সবার কাছে পরিচিত। এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশে আরো ফ্যাসিস্ট শাসকের উত্থান হয়েছে এবং পতন হয়েছে। যেমন: বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, ফ্যাসিবাদ কায়েম করে গণবিপ্লবের মুখে পালিয়ে গেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সকল ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায় আসার ইতিহাস, শাসনব্যবস্থা এবং পরিণতি একরকম ছিল। যেমন: আমরা দেখতে পাই, মুসোলিনি, হিটলার, শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা সবার ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া একইরকম ছিল।
ক্ষমতায় এসে তারা সবাই এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সমালোচনার জবাব দিয়েছিল। মানবাধিকার হরণ, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, প্রতারণামূলক নির্বাচন, লুটপাটের মাধ্যমে তারা সবাই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। একইভাবে গণবিপ্লব বা গণবিক্ষোভের মুখে এই সব ফ্যাসিস্ট শাসকদের পরাজয়ও হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শাসকদের শাসনব্যবস্থা ও পরিণতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হলে পৃথকভাবে ফ্যাসিস্টদের পর্যালোচনা করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসের কয়েকজন ফ্যাসিস্ট শাসকের উত্থান ও পরিণতি তুলে ধরা হলো।
বেনিতো মুসোলিনি
মুসোলিনির শাসনের স্থায়িত্ব ছিল ১৯২২-১৯৪৩। ১৯২২ সালের ৩০ অক্টোবর তার National Facist Party ও Black Shirt বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য ইটালির রাজধানী রোম দখল করে। এই ঘটনা ইতিহাসে 'ক্যু দা মেইন' নামে পরিচিত। পরেরদিন ৩১ অক্টোবর পার্টির প্রধান হিসেবে মুসোলিনি ইটালির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯২৪ সালে ব্যাপক সহিংসতা ও জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসোলিনি ও তার জোট ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনী ৫৩৫ টি আসনের মধ্যে ৩৭৪ টি আসন লাভ করে। এই বিতর্কিত ভোটে তৃতীয় স্থান অধিকারী দল Unitary Socialist Party। এই দলের নেতা ছিলেন গিয়াকোমো ময়াটিওত্তি, যাকে অপহরণ করে হত্যা করে মুসোলিনির বাহিনী। তাঁর অপরাধ ছিল ১৯২৪ সালের জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের কঠোর সমালোচনা করা। তারপর ১৯২৫ সালে বেনিতো মুসোলিনি ১৯২৫ সালে ডুসে বা দ্য লিডার উপাধি গ্রহণ করে। এরপরেই মুসোলিনি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করে, মাত্র দুই বছরের মধ্যে ইটালির সংবিধান বাতিল এবং নির্বাচনীব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। শুধু তাই নয় সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে গুম, হত্যা, অপহরণ চালিয়ে যায়। কথা বলার স্বাধীনতা, রাজনীতি করার স্বাধীনতা উধাও করে দেয়। হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে জেলে আটকে রাখা হয়। অনেককে প্রত্যন্ত দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বিরোধী মত ও পথকে দমনের জন্য প্রচলিত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্য থাকার পরও OVRA (Organisation for the Vigilant Repression of Anti-Facism) গঠন করে। এই OVRA দিয়ে বিরোধী মতের লোকরা গুপ্ত হত্যার শিকার হতো । তিনি এতই কর্তৃত্বপরায়ণ ছিলেন যে, জনগণের খাবারের তালিকাও নির্ধারণ করে দিতেন। তার শাসনের পতনের পরে তিনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষে, ২৮ এপ্রিল ১৯৪৫ তারিখে গুলি করে হত্যা করা হয় মুসোলিনি এবং তার পরিবারকে। হত্যা করার পর মৃতদেহগুলোকে উল্টিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
অ্যাডলফ হিটলার
হিটলারের শাসনের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৩৩-১৯৪৩। হিটলার ১৪ জুলাই, ১৯৩৩ সালে হিটলার নাৎসি পার্টিকে জার্মানির একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করে। নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতাকে বন্দী করা হয়। হিটলারের বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই পুলিশ বাহিনী দিয়ে হাজার হাজার বিরোধী দলের সদস্যদের হত্যা, অপহরণ ও কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। জোসেফ গোয়েবলস নামক এক প্রোপাগান্ডা মন্ত্রীর মাধ্যমে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিতে এক ব্যতিক্রম আয়োজন করেছিল। এই গোয়েবলস-এর মূলনীতি ছিল, একটা মিথ্যা ১০০ বার বললে এটা সত্য হিসেবে গণ্য হতো। এই হিটলার পরাজয়ের মুখে ১৯৪৫ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
শেখ মুজিবুর রহমান
সহিংসতা, ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি ছিনিয়ে নিয়ে একদলীয় শাসনের পথে অগ্রসর হয়। অবশেষে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং অন্যান্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপতি পদে শেখ মুজিব সারাজীবন থাকবে এবং এই পদে কোনো নির্বাচন হবে না মর্মে সংশোধনীও আনা হয়। অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭৫ সালে মাত্র চারটি সংবাদপত্র ব্যতীত বাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। হিটলার, মুসোলিনি ও চসেস্কুর মতো শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক একটি আধা সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। এই বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭৪ সালে জাসদের সমাবেশে গুলি করে ৫০ জনের অধিককে হত্যা করে। ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যা গুম করে হত্যা করে।
এছাড়া হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করে রক্ষীবাহিনী। একইভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল লালবাহিনী নামে আরেক খুনী বাহিনী। এই লালবাহিনীর নেতা ছিলে শেখ মুজিবের অনুগত ও শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মান্নান। এই লালবাহিনী ছিল ফ্যাসিস্ট মুজিবের নিজস্ব প্যারামিলিশিয়া। শেখ মুজিবের শাসনামলে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়মের ফলে নেমে এসেছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ। যখন অনাহারে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন শেখ মুজিব সোনার মুকুট পরিয়ে তার ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়ে আয়োজন করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যার শিকার হলে ঢাকার রাস্তায় আনন্দ মিছিল বের হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তার দলীয় লোকজনও খুশি হয়েছি্লেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আব্দুল মালেক উকিল ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘ফেরাউনের পতন হয়েছে। স্বৈরশাসকের হাত থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে।’
নিকোলাস চসেস্কু
রোমানিয়ার স্বৈরশাসক চসেস্কু ক্ষমতায় ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৯। তার শাসনামলে গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতার কোন সুযোগ ছিল না। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চসেস্কু গঠন করেছিল কুখ্যাত The Securitate নামে গোপন পুলিশ বাহিনী। এই বাহিনী বিরোধী মত ও পথের মানুষের উপর কঠোর নজরদারি করত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের কুখ্যাতি ছিল। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে চসেস্কুর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হলে সামরিক বাহিনী গুলি করে এক হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করে। ২২ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে একাত্মতা পোষণ করলে চসেস্কুর শাসনের পতন হয়। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে একটি বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনালে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করা হয় নিকোলাস চসেস্কুকে। চসেস্কু ও তার স্ত্রীকে একটি ফায়ারিং স্কোয়াডে টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার করে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শেখ হাসিনা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে যখন দেশে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনীব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তখনই এই ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নীলনকশা হাতে নেয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। অবশেষে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে বহুদলীয় নির্বাচনব্যবস্থার পথকে বন্ধ করে দেয় হাসিনা। তারপর শুরু করে গুম, খুন, লুটপাটের শাসন। Digital Security Act নামে এক কালো আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক-সাধারণ নাগরিকদের মত-প্রকাশের স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়। অন্যায়ভাবে দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, শীর্ষ নিউজসহ অসংখ্য পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাগর-রুনীসহ শত শত সাংবাদিককে খুন করা হয়। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ অসংখ্য সাংবাদিককে জেলে নিয়ে দীর্ঘদিন অকথ্য নির্যাতন করা হয়।
২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে গণহত্যাকান্ড, ২০১৩ সালের ৫মে শাপলা চত্বরে গণহত্যাসহ হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুম-খুন করে হাসিনার খুনী বাহিনীর সদস্যরা। আয়নাঘর নামক গোপন টর্চার সেল গঠন করে অসংখ্য বিরোধী নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়। গুম কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিশন ১ হাজার ৮৩৭টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। প্রতিবেদন মতে, গুম করে শেখ হাসিনার খুনী বাহিনী গুমের শিকার ব্যক্তিদের চেতনানাশক ব্যবহার না করে ঠোঁট সেলাই করে দিত, যৌনাঙ্গ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দিত, লাশ রেললাইনের ওপর রেখে ছিন্নভিন্ন করে দিত। আধুনিক যুগে এমন ভয়ংকর মানবাতাবিরোধী ঘটনা পুরো পৃথিবীতে বিরল।
গুম-খুন-নিপীড়নের মতো লুটপাট ও অর্থপাচারের জন্য কুখ্যাত হয়ে থাকবে শেখ হাসিনার শাসনামল। তার আমলেই ব্যংকিং চ্যানেলে পাচার করা হয় ১৭ বিলিয়ন ডলার। যার উল্লেখযোগ্য অংশ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা ও আওয়ামী লীগের নেতারা, আওয়ামী ব্যবসায়িক কর্পোরেট চক্র লুটপাট করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ১৫ বছরে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা টাকা অপচয়-লুটপাট করা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দুই হাজারের বেশি সাধারণ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে শুধু ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে। শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে গণহত্যা এবং শতাধিক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনে যুদ্ধ ব্যতীত কোনো দেশে এমন হত্যাযজ্ঞের নজির বিশ্বে নেই। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়েছে খুনী হাসিনার পুলিশ, বিজিবি এবং দলীয় ক্যাডারদের হাতে। যাদের অনেকে কয়েক হাজার মানুষের অঙ্গহানি হয়েছে। অবশেষে গণবিপ্লবের মুখে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
ফ্যাসিস্ট শাসকদের উত্থান, শাসন ও পতনের পর্যালোচনা শেষ এটা বলা যায় যে, যুগে যুগে যত ফ্যাসিস্ট ছিল তাদের উত্থানের ধরন ছিল এক। তাদের অত্যাচারের ধরনও ছিল এক। একইভাবে তাদের পতনের ধরনও ছিল এক। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের পর্যালোচনায় আমরা আরও দেখেছি, ফ্যাসিস্টদের পতনের পর প্রতিটি পতিত ফ্যাসিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট দলের অপরাধী নেতাকর্মীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তেমনি মুসোলিনি, হিটলার , চসেস্কুর পরিণতির মতো খুনি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে এদেশের মজলুম জনতা।
লেখক: গবেষক ও তথ্য-বিশ্লেষক