হার না মানা মেধাবীদের প্রতিবন্ধকতার চোখে স্বপ্ন জয়!

তিন শিক্ষার্থী
তিন শিক্ষার্থী  © ফাইল ফটো

বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো ওরাও। জীবনের শুরুতেই দরিদ্রতা আর নানা অসঙ্গতির সঙ্গে নিত্য লড়াই যেন ওদের নিয়তি। তবে নানা প্রতিকূলতার সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করেও জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মৌলভীবাজারের বেশকিছু মেধাবী তরুণ-তরুণী। শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের নানা প্রতিবন্ধকর স্বত্বেও যাদের সংগ্রাম অনবদ্ধ, এসব বাধা পেরিয়ে জয় করতে চান নিজেদের স্বপ্নটাকে।

মাধ্যমিকে ভালো ফলাফলে দুচোখ ভরা উচ্ছ্বাস থাকলেও উচ্চ শিক্ষার ব্যয় কিভাবে মিটাতে হবে সে দুশ্চিন্তাও প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছে তাদের। তবে সব প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে সফল হওয়ার চেষ্টাটা অব্যাহত থাকছে নিয়মিত। ভবিষ্যতে আরো ভালো ফলাফল করে দেশ গড়ার কাজে অংশীদার হতে চান এসব মেধাবীরা।

কিন্তু আর্থিক সংকটে তাদের ওই স্বপ্ন কি পূরণ হবে? তবে সহপাঠী, শিক্ষক, বাবা-মা, আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহমর্মিতা ও পরামর্শ তাদের সাফল্যের পেছনে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তারা।

পিএসসি ও জিএসসিসহ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দরিদ্র মেধাবী আজমলদের। কেউ দিনভর টিউশনি করেছেন, রাতে বসেছে পড়তে। এত কষ্টেও দমেনি ওরা। পা রেখেছে সাফল্যের প্রথম সোপানে। দারিদ্র্যের কাছে হার না মানা সেই সব অদম্য মেধাবীদের নানা প্রতিবন্ধকতার কথায় তাদের স্বপ্ন জয়।

আজমল হোসেন: আজমলের ঘাম ঝরানো সাফল্যটা একটু ব্যতিক্রম। মৌলভীবাজারের রাজনগর পোর্টিয়াস মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। তার মা মারা গেছেন অনেক আগে। রাজনগর সদর ইউপি চেয়ারম্যানের দেওয়া পাঁচ শতাংশ জমির উপর তাদের ছোট্ট ঘর। সে আর তার বাবা থাকেন সেই ঘরে। বাবা বেলাল আহমদ দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইসিস রোগী। বাবার চিকিৎসা ঔষধের টাকা সবকিছুই আজমলকে বহন করতে হয়। পড়া-লেখার খরচ, বাবার চিকিৎসা সবকিছু বহন করতে গিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে প্রায় কাটে তার দিন-রাত।

আজমল মা-বাবার একমাত্র সন্তান। স্কুল ছুটি হওয়ার পর ৪/৫টি টিউশনি করতেন আজমল। টিউশনির টাকা দিয়েই চলতেন। বোর্ড বইয়ের বাহিরে নিজের ছিলনা কোনো গাইড বই কিংবা কোন সহায়ক সাজেশন। তার পরেও নিজের চেষ্টা ও আন্তরিকতায় এই ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

এবারের মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ সাফল্যের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলা হয়েছে। তিনি জানান, পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ার পরও আমাদের অভাবের সাংসারিক জীবন আমাকে অনেক কষ্ট দিতো। মা তখন জীবিত ছিলেন। মা কখনো কাজ করতে দিত না আমায়। তার ইচ্ছা আমি লেখাপড়া করে বড় হয়ে ডাক্তার হবো। হয়তো আজ আমার এ ছোট্ট সফলতার কথা শুনলে মা অনেক খুশি হতেন। তিনি জানান, আমি বড় হয়ে মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চাই।

আজমল সম্পর্কে রাজনগর সদর ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান খয়রুল মজিদ ছালেক বলেন, ছেলেটা খুব সহজ সরল। প্রায় সময় আমি দেখতাম সে কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। সময়কে অনেক গুরুত্ব দিতো সে। এই বয়সে ছেলেরা অনেক দুষ্টু থাকে। এলাকার অনেক ছেলের বিচার করেছি। কিন্তু অভিভাবকহীন এই ছেলের বিরুদ্ধে কেউ কোন নালিশ করেনি। চাই ছেলেটা অনেক বড় হোক।

তাহমিদা আক্তার: মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রাজনগর আইডিয়াল হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাহমিদা। তাহমিদার বাবা নজরুল ইসলাম একজন রাজ মিস্ত্রী। পাকার কাজ করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকম চলছে তাদের পরিবার। ৩ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে তাহমিদা তৃতীয়। তাহমিদার বাবার পক্ষে লেখাপড়ার ব্যয় বার বহন করতে না পারায় বড় দুই বোনকে ইতি মধ্যে পাত্রস্থ করেছেন দরিদ্র বাবা। তাহমিদার স্বপ্ন লেখাপড়া করে ডাক্তার হওয়া। কিন্তু টাকার অভাবে এ স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হবে বুঝে উঠতে পারছেন না তাহমিদা। সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতেও জিপিএ-৫ পেয়ে ছিলেন।

রাজনগর আইডিয়াল হাই স্কুলের শিক্ষক আবু রাইয়্যান শাহীন জানান, আমরা শিক্ষকেরা তাকে বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়িয়েছি। অনেক সময় খাতা-কলম কিনে দিয়েছি। স্কুলের কোন ফি তার কাছে থেকে আমরা কখনো নেইনি।

মাহফুজা জান্নাত মিমি: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বঙ্গবন্ধু আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাহফুজা। বাবা মইন উদ্দিন দুবাই প্রবাসী। মা অফিয়া বেগম গৃহীনি। ২ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের দক্ষিণ পাশের ভুকশিমইল ইউনিয়নের বাদে ভুকশিমইল গ্রামের বাসিন্দা মাহফুজা। নানা প্রতিকূলতা ও গ্রামের বৈরি পরিবেশের মধ্যেও প্রবল ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাহফুজা তার এ সাফল্য অর্জন করেছেন। সে লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়ে হাকালুকি হাওর পারের অবহেলিত মানুষের জীবনমানের এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চায়।

মাহফুজার মা আফিয়া বেগম জানান, মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই পড়া-লেখায় অনেক ভালো। তবে টাকা পয়সার অভাবে মেয়েটার পড়া লেখার কোন খরচ বহন করতে পারিনি। সংসারের সকল কাজ শেষ করে মিমি স্কুলে যেতো। কোন কোন দিন তাকে না খেয়ে স্কুলে যেতে হতো। সংসারের এই দরিদ্রতায় তার স্বপ্ন কতোটুকু বাস্তবায়ন হবে তা আমার জানা নেই।


সর্বশেষ সংবাদ