সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রধান চিন্তার সংকট কী?

খোন্দকার কাওসার আহমেদ
খোন্দকার কাওসার আহমেদ  © টিডিসি সম্পাদিত

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ একে অপরকে অনুসরণ করে চলে, চলবেও। এটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই অনুসরণ পর্ব যদি দীর্ঘ হয়, এবং একটানা একইভাবে চলতেই থাকে, তাহলে সেটা হয়ে যায় ‘গতানুগতিকতা’ (Conformity)। এখন কথা হলো, গতানুগতিকতার অনুসরণ সবক্ষেত্রে সর্বদা ভালো নাকি মন্দ? এ প্রশ্নের আমরা মীমাংসা খোঁজার চেষ্টা করব। একটা উদাহরণ ও আলোচনার মাধ্যমে বক্তব্য তুলে ধরব। 

আমাদের দেশের লেখাপড়ার কথা বলা যেতে পারে। এখানে কী হয়? শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যায় এবং তারচেয়ে অধিক পরিমাণে প্রাইভেট ও কোচিংয়ে যায়। এসব জায়গায় শিক্ষার্থীরা খুব সামান্যই শেখে; কিন্তু বিস্তর বিদ্যা গিলে পরীক্ষায় খাতায় উগরে দিয়ে প্রথমত নম্বর, তারপর সনদ এবং অবশেষে চাকুরির পেছনে ছুটতে থাকে।

বিদ্যা গিলানো থকে শুরু করে পরীক্ষা, নম্বর ও সনদ—এ সকল গতানুগতিক অনুসরণের কারবার যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে জেঁকে বসেছে, তার ভারে শিক্ষার উদ্দেশ্যই চাপা পড়ে গেছে।

গতানুগতিক অনুসৃতির ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার যে হালত বিরাজমান; তার জন্য কারিকুলাম, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষা বোর্ড ও এনসিটিবির মতো প্রতিষ্ঠানের দরকার হয় না। বিদ্যা গিলানো, পরীক্ষা, নম্বর ও সনদ—এইসব গতানুগতিক কাজের জন্য বিদ্যালয়, প্রাইভেট ও কোচিং-ই যথেষ্ট!

শিক্ষা নিয়ে উক্ত উদাহরণ পেশ করার মানে হলো গতানুগতিক দীর্ঘ অনুসরণের ফলে শিক্ষার মতোন গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্রের সুফল বা উদ্দেশ্যই মাঠে মারা গেছে! তাহলে শিক্ষার সুফল বা উদ্দেশ্য কী—এইটা ভিন্ন আলাপ। শুধু একটু নোক্তা দিয়ে রাখি, শিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য যদি হয় উত্তম ব্যবহার শেখা, কিংবা আচরণের যুগোপযোগী কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সেটা কি বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বারা হয়? হয় না যে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আরেকটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলে তা হলো, এইদেশে অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্থ লোকজন কারা?

কেবল শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়—ধর্ম, অর্থ, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেই গতানুগতিকতার এমন অন্ধ অনুকরণের বৃত্তে জাতি আটকে পড়েছে যে, আমরা আর শুভ ও সুন্দর পরিবর্তনের হাত ধরে এগুতেই পারছি না!

০২
দার্শনিক হেগেল এবং কার্ল মাক্সের দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো সমাজ আগায় তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এগুলো হলো ‘স্থাপন’ (Thesis), ‘বিপরীত’ (Antithesis) এবং ‘সংশ্লেষণ’ (Synthesis)। সেই আগের উদাহরণেই যাই, তাহলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।

শিক্ষার্থীরা বিদ্যা গিলে, তারপর তা পরীক্ষার খাতায় উগরে দেয় এবং সেই বমি ঘেঁটে শিক্ষকরা নম্বর দেন। শিক্ষার্থীরা সনদ অর্জন করে থাকে। এই যে চলমান শিক্ষা-দীক্ষার ওপর আমরা স্থির আছি, এইটা হচ্ছে স্থাপন বা Thesis। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা হলো বিপরীত বা Antithesis। এখন শিক্ষা-ব্যবস্থা এমন একটা কাঠামো দাঁড় করালো যে নম্বর হাসিলের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিংয়ে দৌড়াতে হচ্ছে না, বিদ্যালয়েই সকলকে সমান পরিচর্যা দেওয়া হচ্ছে, বিদ্যা গিলিয়ে পরীক্ষার খাতায় উগরানোর পরিবর্তে বরং হাতে-কলমে বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা শেখানো হচ্ছে, এবং সেভাবে মূল্যায়নও করা হচ্ছে; এমন নতুন শিক্ষা-কাঠামোই হলো সংশ্লেষণ বা Synthesis।

ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকের ঘটনা। আরবের রেওয়াজ অনুযায়ী একদা রাসুল (সা.) সাফা পর্বতের মাথায় ওঠে মক্কার প্রধান পরিবারগুলোকে ডাকা শুরু করলেন। সবাই যখন এসে জড়ো হলো, তখন তিনি বলা শুরু করলেন, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? যদি আমি বলি এই পাহাড়ের পেছনে একটি বাহিনী আছে, যারা এক্ষুনি তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে। সবাই তখন একসাথে বলল, হ্যাঁ, কারণ আমরা কখনোই তোমাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি।

এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, আমি তোমাদের সামনে এক কঠিন শাস্তির সংবাদদাতা হয়ে এসেছি। আল্লাহ আমাকে তোমাদের জন্য প্রেরণ করেছেন। তোমরা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করো, না হলে আখিরাতে শাস্তি ভোগ করতে হবে।  

রাসূল (সা.)-এর উক্ত ঘোষণা শোনার পর, তাঁর চাচা আবু লাহাব রাগান্বিত হয়ে বললেন, তোমার সর্বনাশ হোক! এ জন্যই কি আমাদের এখানে ডেকেছো?

চরম সত্য জানার পরও মানুষ গতানুগতিকতার অনুসরণ ত্যাগ করতে চায় না এবং এর মধ্যে যে ভণ্ডামি, ছলনা ও নির্দয় ফাঁকি আছে—তা বোঝার পরও। সম্ভবত এর মূখ্য কারণ হচ্ছে কায়েমি স্বার্থ রক্ষা এবং একটা কমফোর্ট জোনে থাকবার ঝোঁক বা প্রবণতা। এর ফলাফল মারাত্মক!

০৩
গতানুগতিকতার অনুসরণ মানুষকে ‘যা আছে, তাই থাকুক’ এমন একটা মানসিকতার অন্ধকার গর্তে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে সমাজে সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক চিন্তন দক্ষতার বিকাশ ঘটে না। দেখা দেয় Intellectual Stagnation বা বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা।

গতানুগতিক ধারার সমাজে কোনো ব্যক্তি-মানুষ যখন ব্যতিক্রমী বা নতুন চিন্তা হাজির করে, সমাজ তখন তাকে বরদাশত করতে পারে না। নানা কায়দায় কোনো দল, গোষ্ঠী, সমষ্টি বা খোদ সমাজ তাকে থামিয়ে দেয়। এইটাকে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠের Tyranny of the Majority বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার।

একবার ক্লাসে বাচ্চাদের আবেদন পত্র লিখা শেখাচ্ছিলাম। এক শিক্ষার্থী বলে ওঠল, স্যার, এই সবিনয় বিনীত নিবেদন ছাড়া কী আর কোনো কথা নাই? তার জিজ্ঞাসায় আমি খুব কৌতূহল ও উৎসাহ বোধ করেছিলাম। ভেবেছিলাম তাই তো! এমন কথা তো বাপ, দাদা, চোদ্দগুষ্টি ব্যবহার করেছেন। এবার নতুন কথা প্রযুক্ত করার পালা। বাচ্চাদের শেখাতে লাগলাম, ‘বিনম্র আবেদন করছি যে’। এজন্য এক তরুণ শিক্ষক সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে আমাকে নির্দয়ভাবে অপদস্ত করেই তবে ছেড়েছিল। এক শিক্ষক তো শিক্ষার্থীদেরকেও ধমকিয়েছিল—আবেদন পত্রে এইসব হাবিজাবি লিখা যাবে না। 

আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজ এবং শিক্ষকরাও খুব অল্পই গতানুগতিক অনুসরণের বাইরে নতুন চিন্তা ও কাজ করতে পারেন—অথচ, তাঁরাই আবার অন্যের প্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন! স্কুলিং জাহান্নামে চলে যাচ্ছে, আমরা শিক্ষকরা আছি গতানুগতিক ধান্দায় লিপ্ত!

জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, সমাজ যখন গতানুগতিকতার হাত ধরে চলে, তখন অল্প কজনের ব্যতিক্রমী ধারণাগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রবল চাপে চাপা পড়ে যায়। ফলে সমাজে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবন বা ভিন্ন মতগুলি বিকশিত হতে পারে না।

অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, যেমন সোরেন কির্য়ের্কেগার্ড ও সার্ত্রেরাও বলে গেছেন, গতানুগতিকতার ভিড়ে হারিয়ে থাকা মানুষগুলো কখনও স্বাধীন সত্তা নিয়ে নতুন কিছু করতে পারে না।

০৪
যে মুহূর্তে গতানুগতিকতার ‘স্থাপন’ সমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখনই তাকে সম্পূর্ণভাবে ‘নেগেট’ (Negate) বা বাতিল করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিপ্লব হলো সেই নেগেশনের (বাতিলকরণের) চূড়ান্ত ও প্রগতিশীল প্রক্রিয়া। এটি গতানুগতিকতার অন্ধ অনুসরণকে উৎখাত করে একটি নতুন সামাজিক বন্দোবস্তো হাজির করতে পারে।

বিপ্লব মানে কেবল একটা পুরনো কাঠামোকে ধ্বংস করা নয়, বরং সমাজে এমন এক নতুন কাঠামো প্রতিস্থাপন করা; যেখানে Individually প্রতিটি মানুষ স্বাধীন—এই স্বাধীন মানুষেরাই কেবল নতুন চিন্তা, নতুন দর্শন ও নতুন সৃজনশীলতা দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে সক্ষম। কোনো ভিড়ের পালের ভেড়ার পক্ষে সম্ভব না।

বিপ্লব মানে ‘অর্থবহ পরিবর্তন’—এধরনের পরিবর্তন আমরা ‘৭১-এর পরে সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম  ভূখণ্ডে সাধন করতে পারিনি। সর্বশেষ ‘২৪-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েও দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে! পারিনি, পারছিনা—তা ঐ গতানুগতিক অন্ধ অনুসৃতির ফল।

সুতরাং দেশ, জাতি ও সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে গতানুগতিক অন্ধ অনুসরণে অনিবার্য ছেদ ঘটিয়ে এমন এক প্রজন্ম উৎপাদন করতে হবে—যারা গতানুগতিক অনুসরণের বাইরে গিয়ে যুগোপযোগী নতুন চিন্তা ও সৃজনশীলতা নিয়ে উদ্ভাসিত হবে। এই কাজটা তথাকথিত শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়।

খোন্দকার কাওসার আহমেদ: সহকারী শিক্ষক, পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, পাবনা


সর্বশেষ সংবাদ