‘আমরা রোবট নই, আমরা ডোপামিনে আসক্ত’ এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও সকলের সমীপে
- রিফাত আহমেদ
- প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১১:০৯ AM , আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৮ AM
মানুষ যতটা না আবেগে চালিত তার চেয়েও অনেক বেশি বিক্রিয়ার দ্বারা চালিত। মনে করি একজন মানুষ প্রতিদিন সকালে উঠে অফিসে যায়। হঠাৎ একদিন যদি সে বিরক্ত হয়ে বলে যে আজ অফিসে যেতে মন চাচ্ছে না বা ভালো লাগছে না। কিন্তু যদি তাকে অফিসে যেতেই হয় সেক্ষেত্রে তার শরীরটাই শুধু অফিসে যাবে কারণ ব্রেইনে বিপরীত সিগন্যাল তৈরি হওয়ায় অফিসে গিয়ে তার ভালো লাগবে না কাজে মন বসবে না কেননা ব্রেইনে তখন বিপরীত সংঘর্ষ চলমান।
একই কথা একজন শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠানে যাবার বেলায়ও প্রযোজ্য। এমনকি বর্তমানে আসন্ন এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের বেলায়ও। তাদের অনেকেই মনে করে যে এইত আজই পড়তে বসব তবে সকালে ভাল লাগছে না বিকাল থেকেই শুরু করি। এই যে পড়া থেকে পালানোর মনোভাব সিগন্যাল আকারে ব্রেইন পেলো তাই তার বিকেলেও একই মনোভাব তৈরি হবে ফলে রাত থেকে পড়ার প্ল্যান করবে। এভাবে দিন, মাস এমনকি বছর গড়াতে থাকবে পড়ায় মনোযোগ ফিরবে না কখনোই। দেখতে দেখতে পরীক্ষার পূর্বরাত্রী চলে আসবে আর তখন হতাশায় ছেয়ে যাবে সারা শরীর ও মন। কিছুই ভাল লাগবে না। শুধুই ছটফট করবে ভেতরটা যা দেখবে না কেউই যা একান্তই নিজের অনুভবেই থাকবে! এ সুযোগে নফস তখন তাকে পেয়ে বসবে এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রবের সাথে দূরত্ব তৈরি করে দিতে থাকবে।
আমাদের যেকোন বিষয়ে আসক্তি হয় তখন যখন সে কাজটা করলে তৃপ্তি লাগে এবং উপভোগ্য হয়। তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক রাসায়নিক উপাদান ক্ষরিত হয় যা ভালোলাগার অনুভূতির উদ্রেক করে। আমরা এ যুগে খুব অস্থির, ছটফটে আর দ্রুত প্রাপ্তির মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠিতেছি!
ফেইসবুকে রিলসগুলো মিনিটের চেয়েও কম সময়ের থাকে যা নিয়ে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকি! প্রতি কয়েক সেকেন্ড পরপর আমাদের ভালোলাগা কাজ করে এবং ডোপামিন ক্ষরিত হতে থাকে ফলে সে জিনিসটা না করলে আমাদের অস্থির অস্থির লাগে।
এর আর একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তা হচ্ছে আমাদের দীর্ঘমেয়াদের পড়াশোনা তখন আর ভাল লাগে না কেননা পড়াশোনা কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটে সম্পন্ন করার জিনিস না। অনেকটা সময় ধরে লেগে থেকে তা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু সে দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা করে পূর্ণতা প্রাপ্তির উপভোগ করা আমরা যেন ভুলেই যেতে বসেছি ২০ সেকেন্ডের রিলসের যুগে! পড়াশোনার দ্বারা আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনও ক্ষরিত হয় না আমাদের তা ভালোও লাগে না।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায় সময়ই অযৌক্তিক কারণে পরীক্ষা পেছাতে চায়। এমনি এমনি ফলাফল পেতে চায়। এটা তাদের ভেতরের হতাশারই প্রতিফলন। আমরা কিন্তু রোবট নই যে সুইচ দেয়া হলো পড়ায় মনোযোগ বৃদ্ধির ফলে মনোযোগ বাড়তেই থাকল! বরং আমাদের আবেগ অনুভূতির কারণে মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদান ক্ষরিত হয় ফলে হাসি আনন্দ আসে এবং আমরা কাজ করার আগ্রহ পাই আবার তা হারিয়েও যায়। এ বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি।
এ যুগ বড়ই সংক্ষেপে প্রাপ্তির যুগ! T-20 এর পর T-10 আসার পরিকল্পনায় রয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। ওয়ানডেও তো হারিয়েই যেতে বসেছে আর টেস্টের কথা বাদই দিলাম। আমাদের সারাদিনের খোরাক হচ্ছে ইউটিউব এবং ফেসবুক! কারো কারোর আরো বেশি আছে যেমন টিকটক, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি। সেসব জায়গা থেকে গাণিতিক সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত আমাদের যার যা ভাল লাগে তা পেতেই থাকি অডিও, ভিডিও বা পোস্ট আকারে এবং তা অনেক সংক্ষেপে কিন্তু পুরো চিত্রই তুলে ধরা থাকে সারমর্মের মতো! এর ফলে আমাদের প্রজন্ম সংক্ষেপে প্রাপ্তির নেশায় মেতে উঠেছে। তারা ১২-১৫ বছর ধরে পড়াশোনার আগ্রহ ধরে রাখার ধৈর্য আর পায় না! প্রতিটা বছর পার করে রিক্ত হস্তে! এটা কি শুধুই পড়াশোনায়? নাকি আমাদের সকলক্ষেত্রে একই চিত্র! আমরা প্রতিটা দিন পার করছি শূন্যতায় এবং নিজেদেরকে অন্তসারশূন্য মানুষরূপে গড়ে তুলছি প্রতিদিন!
আমরা জনসংখ্যায় বেশি হয়েও আনন্দিত হতে পারি না কেননা আমরা মানব বোঝা তৈরি করছি দিন দিন। আর ওদিকে অনেক শক্তিশালী দেশ নিজেদের শক্তিহীন ভাবতে শুরু করেছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে দিন দিন কমতে থাকায়! একটা শিরোনামই তো হলো কয়দিন আগে যে ''বুড়িয়ে যাচ্ছে জাপান''! ২০২৪ সালে জাপানে জন্ম নিয়েছে ৭ লাখেরও কম আর মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ। তারা নিজেদেরকে যথাযথ পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি সময় চালিত করে মানব সম্পদরূপে গড়ে তুলে তাই লোকের অভাবে সম্পদের অভাব বোধ হচ্ছে তাদের!
আমাদের অনিবার্য ধ্বংসের এ পথের সমাধান কী? সমাধান একটাই আর তা হচ্ছে হাতে যা সময় হাতে আছে তার সর্বোচ্চ ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করা। এর জন্য পরিকল্পনা নয় বরং এ মুহূর্ত থেকেই ঘুরে দাড়ানোর প্রত্যয়ে দীপ্ত হওয়া, সন্তুষ্টচিত্তে পড়ায় বা কর্মে মনোনিবেশ করা আর রবের সান্নিধ্য পেতে যা যা করণীয় তাতে ঘুণাক্ষরেও আপোস না করা। মোবাইলে মিউজিক ও রিলস দেখা পরিহার করা, ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং মহান আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ধৈর্যশীল হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনে, কর্মে, পড়াশোনায় এবং ধর্মীয় কাজে নিবেদিত হবার তওফিক দান করুক এবং মোবাইল ফোন থেকে, এর ফিতনা থেকে এবং যাবতীয় অশ্লীলতা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার তওফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: রিফাত আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক (রসায়ন), শ্রীবরদী সরকারি কলেজ, শেরপুর।