ঈদ আনন্দের সেকাল-একাল

প্রতীকী
প্রতীকী  © সংগৃহীত

ছোটবেলা হারিয়ে গেছে বড় হওয়ার ফাঁকে, আজও কি কেউ খেলবি বলে ডাকে? ভাবনার মোহনায় বসে সেই সময়ের কথা ভাবি যখন ঈদ আমাদের জীবনে আসতো এক নির্ভার ও প্রাণোচ্ছল আনন্দ নিয়ে। হুম, আমি স্মৃতিময় সেই শৈশব কৈশোরের কথাই বলছি। ঈদ মানে তখন ছিল যেন এক বাধভাঙ্গা আনন্দের ক্ষণ। যে আনন্দ ছিল বড়ই মুক্ত ও বিষহীন। আজ ঈদুল আযহা নিয়েই বলি। চাঁদরাতে আমাদের যতসব দুরন্তপনা ছিল কোরবানির গরুকে নিয়ে। গেরস্ত বাড়ি বা হাট থেকে গরুকে আনার পর প্রথমে গাছের বা বাঁশের সাথে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। 

তারপর তাঁর ভূরিভোজনের ব্যবস্থা করার পালা। খৈল, ভূষি, তাজা ঘাস ও লতাপাতাসহ নানান জিনিস এনে হাজির করতাম আমরা। সবাই তাঁর জাবর কাটা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। যদিও এমন অচেনা ও নতুন পরিবেশে গোগ্রাসে খেতো পারতো না সে। এভাবে বিকেল পেরিয়ে ক্রমেই যখন ঘুটঘুটে সন্ধ্যা গড়াতো তখন জমতো আরো মজা। মশা তাড়ানোর জন্য আমরা আগুন জ্বালিয়ে দিতাম গরুর আশেপাশে। অতঃপর ছড়িয়ে দেয়া ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হতো যেন সারা বাড়ি। বাড়ির উঠোনে মুরব্বিরা চেয়ার কিম্বা পাটি পেতে বসতেন। চুন খসা পানের খিলিতে জমতো পুরনো দিনের গল্প। 

এদিকে ঈদের দিন স্বাচ্ছন্দ্যে গোশত কাটার জন্য পাড়ার গৃহবধূরা দা বা বটিতে শান দিয়ে রাখতো, সাজিয়ে রাখতো বিবিধ মসলার জাত। এভাবেই মুক্ত আনন্দ  ও আবহমান বাংলার সোনালি জীবনবৈচিত্র্যে কাটতো আমাদের চাঁদরাত। 

ঈদের দিন সকালে উঠেই আমুখে গরুর কাছে চলে যেতাম। অবাক চোখে দেখতাম গরুর দুচোখ ভরা অশ্রুজলে ভাসা গম্ভীর মুখখানা। হয়তো ঐশ্বরিক শক্তিবলে সে জেনে যেতো গতকাল রাতই তাঁর জীবনের শেষ রাত ছিল তাই এমন বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে সে। গরুর এহেন সুরত দেখে আমরাও আবেগাপ্লুত হতাম। তারপর গরুকে গোসল সারিয়ে যেতাম পুকুরে। 

পরিপাটি হয়ে ঈদের সালাত শেষে প্রধান কাজ গরু জবাই করা। বেশ কয়েকজন চৌকস লোক দিয়ে কৌশলে গরুকে শোয়ানো হতো। তারপর পাড়ার ইমামসাব এসে গরুর গলা ধরে আল্লাহু আকবর বলে জবাই দিতেন। ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্তের স্রোত আশেপাশে ছড়িয়ে স্নাত হতো। টকটকে লাল রক্তে পা দিয়ে মাড়াতাম আমরা অনেকেই। প্রচলিত ছিল, গরুর রক্তে পা মাড়ালে নাকি চর্মরোগের উপকার পাওয়া যায়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ঐশী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই যুগে এসে জানলাম, গরুর রক্তে পা মাড়ালে চর্মরোগের উপকার পাওয়া যায়—এমন ধারণা একটি লোকজ বা প্রাচীন কুসংস্কার হিসেবে সমাজে প্রচলিত আছে, কিন্তু এর ইসলামিক বা বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। 

গরু জবাই, ভাগ বাটোয়ারা, গরীব-মিসকিনদের দান শেষে চলতো ঘরে ঘরে আয়োজন। চালের রুটি আর মুখরোচক গোশতভুনা মহা সোৎসাহে রান্না হতো। একে অপরের ঘরে খেতে যেতামল। এতে প্রতিবেশীদের সহিত সম্প্রীতি দৃঢ় হতো। এভাবেই ঘটতো কুরবানির ঈদের ইতি। 

শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের এই সময়েও বরাবরের মতোই ঈদ আসে। কিন্তু, এখন কি আর নির্ভার? না—সিটি, কিউটি, ল্যাব, প্রেজেন্টেশন আরো কত কি প্রেশার মাথায় নিয়েই ঈদ দিব্যি কেটে যায় বাড়িতে কিম্বা ক্যাম্পাসে। কিন্তু সেই আগেকার আবহমান আমেজ যেন আমাদের এইজের জেনারেশনের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে দূরে, বহুদূরে। 

 লেখক: তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!