‘মহান স্বাধীনতা ঘোষণায় জিয়া: একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা’
- খালেদ সাইফুল্লাহ
- প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৮ PM , আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০৩ PM

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে (অপারেশন সার্চলাইট) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনের ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। সমগ্র জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় নিপতিত হয়, তখন মেজর জিয়া বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে ধ্রুবতারার ন্যায় আবির্ভূত হন।
এদিন জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসরত পাকিস্তানি এক জেনারেলের কাছে তাঁকে পাঠানো হয়। মেজর জিয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁকে ‘গ্রেপ্তার বা হত্যা’ করার (তথ্যসূত্র-গোলাম মুরশিদ, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস)। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শোনামাত্র বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় সমগ্র বাঙালি জাতি ছিল দিকনির্দেশনাহীন,নেতৃত্বশূন্য এবং দিকভ্রান্ত। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এসে তাঁর কমান্ডিং অফিসার জেনারেল জানজুয়াসহ অন্যান্য পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে বন্দী করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্দীপনাময় ও উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণ দিতে শুরু করেন (শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র)।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে মেজর জিয়া চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে প্রভিশনাল হেড অফ বাংলাদেশ হিসেবে উল্লেখ করে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি,‘We Revolt' ঘোষণা দিয়ে নিজেও দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত জাপানি জাহাজ থেকে অস্ট্রেলিয়া রেডিওতে ঘোষণাপত্রটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও সর্বপ্রথম তার ভাষণটি প্রচার করে। পরবর্তীতে বিবিসি, দি স্টেটসম্যান পত্রিকার মাধ্যমে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা সারা বিশ্বে প্রচাবিত হতে থাকে।
মেজর জিয়ার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি ছিল: Dear fellow freedom fighters, I Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in- Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle. Bangladesh is independent. We have waged war for the libreation of Bangladesh. Everybody is requested to participate in the liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from the occupation of Pakistan Army.
Inshallah. victory is ours.
পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধক্রমে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যা ২৭ মার্চ ও ২৮ মার্চ প্রচারিত হতে থাকে। এ ঘোষণাটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা দলিলপত্র :তৃতীয় খন্ডের ২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তাঁর ‘Bangladesh at War’ গ্রন্থে লিখেছেন, মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। এতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়করূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।(পৃষ্ঠা নম্বর ৪০-৪৫)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ সংক্রান্ত দলিলপত্রে বলা হয়েছে, On March 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and a provisional government under the leadership of a Major Zia.
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
আরো পড়ুন: সেনা-ছাত্র-জনতা: জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লব
ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভারত রক্ষক শিরোনামে বাংলাদেশ বিষয়ক ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ৯৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৬ তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তিনি ‹বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের (Temporary Head of Republic) দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন।’
ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘History of freedom movement of Bangladesh’ গ্রন্থে বলেন মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের (মুজিবনগর সরকার) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে তাজউদ্দিন আহমদ মেজর জিয়াউর রহমান কে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন [Bangladesh Documents, vol-I, Indian Government, Page 284] .
মইদুল হাসান তার মূলধারা: ৭১ এ লিখেছেন, মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন (পৃষ্ঠা- ৫ ও ৬,ইউপিএল ১৯৮৬)।মেজর জিয়া শেখ মুজিবের নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বললেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আগেকার ঘোষণা সংশোধন করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর উত্তম) তাঁর A Tale of Millions গ্রন্থে লিখেছেন, ‘..........২৭ মার্চের বিকালে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’ কেন জিয়া মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক- উল ইসলাম বলেছেন: ‘একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা দিলে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই ঘোষণা সামরিক অভ্যুত্থানরূপে চিত্রিত হতে পারে, এই ভাবনায় মেজর জিয়া পুনরায় ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। এই ঘোষণা শোনা যায় ২৮ মার্চ পর্যন্ত।’এ সময় তিনি মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। (পৃষ্ঠা-১৫৮)
মেজর সুবিদ আলী ভুঁইয়া তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এখানে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বেতার কেন্দ্র থেকে যাঁরা সেদিন মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তাঁর হেড অব দি স্টেট ‹ অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধানরূপেই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।’ তিনি আরো লিখেন, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা এই যে, জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগ নিয়েই এই ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। এতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কতটুকু সুবিধা হয়েছিল তাও বিচার্য। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার নিরিখে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মান ছিল অত্যন্ত উঁচু।
সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ওই সেনাবাহিনীর অফিসার হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণার ঝুঁকি নেওয়াটা কম কথা নয়। এর একটা মারাত্মক দিকও ছিল। বিদ্রোহ যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত তাহলে যারা সেনাবাহিনীতে ছিলেন, মিলিটারি বিচার অনুযায়ী তাদের ভাগ্যে কি জুটত? সামরিক বাহিনীতে যারা ছিলেন এবং যাদের নাম বিপ্লবের শুরুতেই জানাজানি হয়েছিল তাদের ভাগ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না।
পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, ইতিহাসে বিদ্রোহ করার অপরাধে সামরিক বাহিনীর কত লোকেরই না ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যেতে হয়েছে। বিদ্রোহ যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো এবং তৎকালীন পাকিস্তান সরকার টিকে থাকত তখন আমাদের অবস্থাও তাই হতো(পৃষ্ঠা ৫৩)। এভাবেই জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। এর মাধ্যমেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মেজর জিয়া ছিলেন ফিনিক্স পাখি বা হ্যামিলিয়ানের বাঁশিওয়ালা। সেনাবাহিনীর একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা হিসেবে তিনি একটি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হয়েছিলেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপামর সাধারণ জনগণ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তিনি জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো তাহলে নিশ্চিত সেনাবাহিনী কোর্ট মার্শাল আইনে এই সাহসী বীরের মৃত্যুদণ্ড হতো।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত ১৭ বছর আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী এই বীরকে মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে, শুধু তাই নয় তাকে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সম্মানসূচক 'বীরউত্তম"উপাধি কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তারা ইতিহাসের এই রাখাল রাজাকে মানুষের মন থেকে সরাতে পারেনি। তিনি আছেন বাংলাদেশের সকল জনগণের মনের মনিকোঠায়। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এই স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: ছাত্রদলের সাবেক কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়