ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিতৃষ্ণার কারণ ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তি’

মো. আনোয়ার হোসেন
মো. আনোয়ার হোসেন  © টিডিসি ফটো

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে রাজনৈতিক চর্চা  স্বাভাবিক বিষয়। এরিস্টটলের মতে, মানুষ রাজনৈতিক জীব। এটা চরম সত্য কথা। আপনি চাইলেও রাজনীতি থেকে বের হতে পারবেন না। এমনকি আজকে জন্ম নেওয়া শিশুটিও রাজনীতির বাইরে না।

তবে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি দলীয় হস্তক্ষেপ, লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাসী চর্চা ও পেশিশক্তির রাজনীতির সমর্থক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছাত্ররা রাজনীতি করতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ও মানুষের কল্যাণে।

ছাত্ররাজনীতির সুফল তো তারাই জানেন যারা ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে  পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। বর্তমান সন্ধিক্ষণে শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির পরিবর্তে মূল দলের নেতৃত্বের অন্ধ অনুকরণ ও তাদের হুকুম মান্য করাকেই ছাত্ররাজনীতি হিসেবে শিক্ষার্থীদের মন জগতে ধরা দিয়েছে।

ফলে শিক্ষার্থীরা এবিষয়ে বিমুখ হয়ে তাদের মনে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে বিতৃষ্ণা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি বলতে আমরা বুঝি, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বলতে গণরুম, হলের সিট বাণিজ্য, র‍্যাগিং, চাঁদাবাজি, ট্যান্ডারবাজি, ধর্ষণ, নির্যাতন, শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব খাটানো, মাদক সিন্ডিকেট গড়ে তোলাসহ নানানরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্রপট শিক্ষার্থীদের সামনে ভেসে ওঠে।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে ৮ জনের জন্য তৈরি এক একটি হলের রুমে ৩০-৩৫ জন এমনকি আরও বেশি শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে গণরুমে থাকতে হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুম যেন নবীন শিক্ষার্থীদের ম্যানার শেখানো কক্ষ।

সম্প্রতি ধর্ষণ যেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ছাত্র এবং শিক্ষকদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোকে এখন মামুলি ব্যাপার হিসেবে ধরা হয়।

শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় ডিগ্রি ব্যতীত রাজনৈতিক প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতিও এখন স্বাভাবিক বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অপরাধের অভিযোগ উঠলেও তদন্ত কমিটি গঠন এবং সিন্ডিকেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বিষয়টি।

এখন বিশ্ব‌বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশের মান উন্নয়নে রাজনী‌তি একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। ‌যেটা বাংলাদেশের ছাত্ররাজনী‌তির ই‌তিহাস থেকে সহজে অনুমেয়। আগে ছাত্ররাজনীতি করতো মেধায় শুরুর দিকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর এখন তার উল্টো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া একাধিক বিবৃতি অনুযায়ী, ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে তাদের সহপাঠীদের সাথে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না।

ছাত্ররাজনীতির বিগত বছরগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময় ছাত্ররাজনীতি আমাদের দেশে তেমন কোন সুফল বয়ে আনেনি। উল্টো অনেক অপরাধের জন্ম দিয়েছে। যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সে সরকারের পৃষ্ঠপোষক দল রাজনীতির নামে পুরো ক্যাম্পাসকেই উত্তপ্ত করে রেখেছে।

খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য এমন হেন অপরাধ নেই যা সংঘটিত হয়নি ক্যাম্পাসগুলোতে। আবরারের ঘটনায় বুয়েট ছাত্ররাজনীতিকে ভয় পায়। এই মুহূর্তে একটা বড় সংকটের মুখে পড়বে বুয়েট প্রশাসন।

একদিকে সিংহভাগ ছাত্রের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির না চাওয়া, অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে আদলতের রায়। এখন দুই দিকের কথা মাথায় রেখে বুয়েট প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী বলতে গেলে তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

তারা চায় না দলীয় রাজনীতি আবার ফিরে আসুক। আবারও আবরার ফাহাদ কাণ্ড ঘটুক। দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রাজনীতি চর্চা হয়। মেধার স্বাক্ষরতায় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েট  রাজনীতি মুক্ত রাখার মাধ্যমে সরকার চিহ্নিত করতে পারেন রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস শিক্ষার জন্য বেশি উপযোগী নাকি রাজনীতিযুক্ত ক্যাম্পাস।

মোদ্দাকথা হল বর্তমানে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি দেশের হাল ধরেছেন তাদের অধিকাংশেরই বয়স ৬৫ বছরেরও ঊর্ধ্বে। একদিকে বলা হয় স্মার্ট বাংলাদেশ অন্যদিকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ব্যক্তিবর্গই দখল করে আছেন রাজনীতির প্রতিটি শীর্ষ স্থান। স্মার্ট বাংলাদেশের রাজনীতি কি আসলে বয়স্কদের রাজনীতি? এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়।

ছাত্রসংসদ ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি না থাকায় দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারছে না। প্রকৃত জনপ্রিয়, মেধাবী, যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব উঠে আসলে রাজনীতিতে আর শূন্যতা বিরাজ করবে না। তখন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এবং দেশের জন্য কাজ করে যাবে তারা।

রাজনীতি চলে যাবে না অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ব্যবসায়ী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে। তাই ছাত্ররাজনীতি যদি করতেই হয় তাহলে ছাত্র সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি চালু হোক, যাতে  প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারে ।

শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক মানসিকতা বিকাশের স্বার্থে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চায় ঘেরা গণতান্ত্রিক পরিসর সম্পন্ন ক্যাম্পাস প্রয়োজন। তাই দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে ভয়ের সংস্কৃতিমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিতে ছাত্রসংসদ ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে।

সেইসাথে ছাত্র-নাগরিক সংহতি ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে চিন্তাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক পরাজয়কে বরণ করে নিয়েই সাধারণের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাঠামোগত সুস্থ প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা এবং তার মানোন্নয়ন নিয়ে কাজ করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence