গ্যাং কালচার এখন ছোটখাটো মহামারি
- মুহাম্মদ রওশন জামিল
- প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:১৬ PM , আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০১:১২ PM
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণ কিশোর গ্যাং জন্ম নিয়েছে, তাতে গ্যাং কালচারকে ছোটখাটো মহামারির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় কিশোর গ্যাং দ্বারা সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধের সমীক্ষা চোখে পরার মতোই। একুশ শতকের আগে কিশোর গ্যাংগুলো চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ছোট অপরাধের সাথে যুক্ত থাকলেও বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, ভূমি দখল, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহারসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
সাধারণ অর্থে কিশোর গ্যাং বলতে ২৩ বছরের কম এবং তিন বা তার অধিক সংখ্যক সদস্য বিশিষ্ট গ্রুপকে বোঝায় যারা পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে গ্রুপ কালচার প্রতিষ্ঠা করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান, শ্রেণী বৈষম্য, ধর্মীয় আদর্শের ব্যাঘাত এসব কারণ পরবর্তীতে গ্যাংগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে সাহায্য করে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত এসব গ্যাং নিজেদের অবস্থান আরো শক্ত করতে এবং আরো বেশি পরিচিত হয়ে একক আধিপত্য তৈরি করতে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সাব কালচার তৈরি করে।
গ্রুপের সবার একই ধরনের পোষাক, চলাফেরার স্টাইল, চুলের কাটিংসহ একজাতীয় অস্ত্র ও সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে। ব্যক্তি জীবনে ও অনলাইন মাধ্যমগুলোতে এই কিশোররা নিজেদের গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে।
আইনশৃংখলা বাহিনীর তথ্য মতে, শুধু ঢাকাতেই ৮০টিরও অধিক কিশোর গ্যাং প্রায় সাড়ে তিনশো সদস্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যদিও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সংখ্যাটা আরো বেশি।
কিশোর গ্যাং বিস্তারের সাথে করোনা মহামারির কিছুটা যোগসাজশ রয়েছে। স্কুল কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে এসময় কিশোররা সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সেভাবে যুক্ত হতে পারেনি। এসময় শিক্ষা কার্যক্রমসহ বিনোদনের মাধ্যমগুলো অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে যায়।
অনলাইন প্লাটফর্ম গুলোর মধ্যে টিকটক লাইকির মতো বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন ভিডিও গেইম (ফ্রি ফায়ার,পাবজি,ক্লাশ অব ক্লান্স্) খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায় এই স্বল্প সময়ের মধ্যে। গেমিংয়ের সময় পরিচিত অপরিচিত মিলে কিশোরদের মধ্যে একটা বিশাল গ্রুপ খুব সহজেই তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে বাস্তব জীবনে গ্যাং সৃষ্টিতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগে।
টিটকট লাইকির পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কিশোর গ্যাং পরবর্তীতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে।এসব গ্যাংয়ে মেয়ে সদস্যদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে যারা ছেলে সদস্যদের আর্থিক ও শারীরিক সাহায্য দিয়ে থাকে।
সম্প্রতি আলোচনায় আসা বাংলাদেশের ইউটিউবার প্রত্যয় হিরণকে আন্তর্জাতিক জুয়ার সাইটের প্রচার করে ভিডিও বানানোর দায়ে গ্রেফতার করে পুলিশ, সে সহ তার সহযোগীরা দীর্ঘ দিন ধরেই এই অপরাধের সাথে জড়িত। কিশোর গ্যাংগুলোর যোগাযোগের যে বিস্তার এটি দেশের অপরাধ প্রবণতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্মকে নানাবিধ অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে না পারলে এধরনের অপসংস্কৃতি দেশে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে এবং কিশোর বা কিশোরীদের সমাজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।
আরও পড়ুন: ঢাবি শিক্ষার্থীদের গ্যাং কালচারে জড়ানোর নেপথ্যে 'গেস্টরুম' ও 'বড়ভাই'
দারিদ্রতা কিশোর গ্যাং সৃষ্টির একটা কারণ হলেও মূল কারণ নয় কেননা বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাংগুলোর অনেক সদস্য উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসছে। কিশোর গ্যাং তৈরির পেছনে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, মাদকদ্রব্যের সহজ হাতবদল, ছিনতাই,বড় ধরনের অপরাধ সংগঠিত করা এছাড়া ব্যাক্তিকেন্দ্রীক কারণ হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক,অন্য গ্যাং থেকে নিজেকে রক্ষা করা,সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব, বন্ধু কিংবা পরিবার থেকে প্ররোচিত হয়ে ভঙ্গুর সামাজিক বন্ধন, সমাজের অসম বন্টন, মাদক দ্রব্য সংগ্রহ এসবই প্রধান।
নগরায়নের ফলে অগণিত মানুষ গ্রাম থেকে শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে,একটা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন অবস্থানে টিকে থাকতে কিশোররা সহজেই যেকোনো অপরাধের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। একান্নবর্তী ও জোড়ালো সম্পর্কের পরিবারে কিশোরদের বেড়ে উঠাই ছিলো এদেশের প্রচলন যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। এ সম্পর্কের অভাবে বাবা-মা কিংবা প্রতিবেশীর বন্ধনে কিশোরদের রাখা সম্ভব হচ্ছে না, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বের হয়ে এসে যেকোনো অপরাধ সহজে করছে কিশোররা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং গুলোতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দেখা যায়,যা একদল স্বার্থান্বেষী মানুষের সাথে কিশোর গ্যাং সৃষ্টির কারণ নির্দেশ করে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা শিথিল হওয়ায় কিশোর গ্যাং সৃষ্টি ও তাদের অভয় দেওয়ার মাধ্যমে ভূমি দখল, রাজনৈতিক বিবাধ, হাট-বাজার দখল, ছিনতাই, চুরি, মাদক চোরাচালানসহ খুন ও মানব পাচারের মতো অপরাধগুলো দেখা যাচ্ছে।
কিশোর গ্যাং তৈরির পেছনে মিডিয়ার সচেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়ার মাধ্যমে কিশোর গ্যাং ও তাদের অপরাধগুলোকে ঢালাও ভাবে প্রচারের মাধ্যমে তাদের মধ্যে হিরোইজম তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক টিভি সিরিজ, মুভি সৃষ্টির মাধ্যমেও কিশোররা অপরাধ করতে মোটিভেটেড হচ্ছে। গাবতলীতে ধুম-৩ দেখার পর ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে ১৮ বছর বয়সের কিশোর।
উত্তরার স্কুল পড়ুয়া আদনানকে ডিসকো গ্যাংয়ের হত্যা (২০১৭), বারো সদস্যের টঙ্গীর ডিয়ারিং কোম্পানি, সিনিয়র জুনিয়র রেস ধরে তেজগাঁওয়ে আজিজুল হত্যা, টিটটক হৃদয়ের মানব পাচারের সম্পৃক্ততা ও টিটটক স্টার বানানোর কথা বলে কিশোরীকে জোর পূর্বক ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনাগুলোর সাথে কোনো না কোনোভাবে মিডিয়া, রাজনীতি, সমাজ, বিভিন্ন বৈষম্য, পারিবারিক শিক্ষা ইত্যাদি কারণই দায়ী।
২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ঢাকায় কিশোর অপরাধ সংশ্লিষ্ট ৪৬ কেসের মধ্যে মাত্র একটি বর্তমানে বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। বিচার প্রক্রিয়ার এই ধীরগতির কারণে যারা অপরাধের শিকার হয় তারা যেমন সঠিক সময়ে সঠিক বিচার পায়না একই সাথে -ব্যান্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বি, স্টার বন্ডের মতো গ্যাংগুলোর উৎপত্তি রোধ করা সম্ভব হয়না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের মতে কিশোর অপরাধীদের পুনর্বাসন ও সমাজে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান আইন কতটুকু কার্যকর তা ভাববার বিষয়। কিশোর তাদের অপরাধের জন্য দায়ী এটা তাদের বুঝানোর মতো আইন প্রয়োজন। তার মতে কিশোর অপরাধীরা অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবেও ছাড় পেয়ে যায় যা বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়।
সোশ্যাল লার্নিং থিউরি অনুযায়ী মানুষ -সমাজ,পরিবারের সদস্য, বন্ধু, মিডিয়া কিংবা সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম থেকে খুব সহজে বিভিন্ন আচরণ,ধারণা, নিয়মাবলি ইত্যাদি অন্যদের থেকে শিখে থাকে। একইভাবে গ্যাং সৃষ্টি ও অপরাধের বিভিন্ন কলাকৌশল কিশোর এসব মাধ্যম থেকেই রপ্ত করে। এ থিউরি অনুসারে কিশোর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রথমে অপরাধ শিখে এবং পরবর্তীতে এসব জ্ঞান প্রয়োজনে কাজে লাগায়।
সোশ্যাল কন্ট্রোল থিউরি অনুসারে কিশোর তখনই অপরাধ করার কথা ভাববে যখন সমাজের সাথে তাদের বন্ধন ও সম্পর্ক ভঙ্গুর হবে। সমাজ ও পরিবারের সাথে কিশোরের যে বন্ধন তা অপরাধের প্রতি একপ্রকার জবাবদিহিতা ও সংকোচবোধ তৈরি করে যা নষ্ট হলেই কিশোর অপরাধ করতে ভাবে না।
জনবহুল এদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের বড় অভাব যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে শ্রেণি বৈষম্য তৈরি হয়। আর দুই শ্রেণির মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব কিশোর গ্যাং সৃষ্টি ও কিশোর অপরাধ সংঘটিত করতে খুব বেশি ভূমিকা পালন করে। কিশোর অপরাধের সাথে জড়িত অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে সমাজে অবহেলিত, নিপিড়ীত, বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার। অপরাধের মাত্রার তুলনায় শাস্তির মাত্রা কম হওয়ায় রেসনাল চয়েস থিউরি মতে, লাভ ক্ষতি বিবেচনা করে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি ও কিশোর অপরাধ দিনদিন বাড়ছে।
কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জন্য একটি হুমকি;ইতোমধ্যে অন্য দেশের গ্যাংগুলোর সাথে বাংলাদেশের অনেক কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা দেখা যায় যা খুবই আশঙ্কার বিষয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব গ্যাং কালচার সামলাতে ব্যাপকভাবে হিমসিম খাচ্ছে।।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে কিশোর গ্যাংয়ের মতো এতবড় সমস্যা সমাধান সম্ভব নয় এক্ষেত্রে সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণ এবং নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।