গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ছাড়া কীভাবে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ
- শাকিল আহমেদ
- প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ০৮:৫৬ AM , আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩, ০৯:১১ AM
গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অন্যতম হাতিয়ার হলো কমিউনিটি ক্লিনিক এবং উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো)। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পটি শেখ হাসিনা সরকার গ্রহণ করেন এবং প্রায় দশ হাজার ক্লিনিক স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫শ কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। যেখানে একজন করে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থাকার কথা। কিন্তু গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়োগই হয়নি সরকারের এই পদে।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে কারা দিচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা? কে লিখছে প্রেসক্রিপশন আর কে করছে রোগ ডায়াগনোসিস? আসলে এসবের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। যেখানে সাধারণ নিত্য-প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে আছে অ্যান্টিবায়োটিকও। অনেক সময় এসব অ্যান্টিবায়োটিক সিএইচসিপি দের মাধ্যমে দেওয়া হয়, যা মানুষদের আরও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে এসব ওষুধ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সামান্য সমস্যায়ও এই ডিজিটাল যুগে যেতে হয় জেলা সদর হাসপাতাল অথবা উপজেলা হাসপাতালে। তাহলে এস.ডি.জি এর ৩ নাম্বার টার্গেট কীভাবে পূরণ হবে? যদি সামান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় গ্রাম থেকে যেতে হয় জেলা সদর হাসপাতালে। আর এত কমিউনিটি ক্লিনিক করেই বা কী লাভ, যদি এর অন্যতম পদ (উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার) ই ফাঁকা থাকে। মূলত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নিয়োগ হয় মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের। কিন্তু নিয়োগ না থাকায় এসব মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্টরা পরিবারের বোঝা হচ্ছে এবং তাদের দক্ষতাকেও তেমন কাজে লাগাতে পারছেনা। অন্যদিকে গ্রামীণ মানুষও পাচ্ছেনা তেমন সুচিকিৎসা।
সংবিধানের ২৯ নং ধারা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকার কথা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি-২০২৩ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ২৯৫০টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ পদই ডিপ্লোমা কোর্স পাসকৃত শিক্ষার্থীদের নার্সদেরও আছে ২০০০ এর বেশি পদ কিন্তু গত ১০ বছরে তেমন কোনো নিয়োগই পাননি মেডিকেল এসিস্টেন্ট ট্রেনিং স্কুল থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীরা।
এসএসসি পাশের পর ম্যাটসে ভর্তি হয়ে যেন এক প্রকার ফাঁদে পা দিচ্ছে এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীরা। গ্রাজুয়েট এবং অন্যান্য ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকুরীতে আবেদনের সুযোগ পেলেও ম্যাটসের ছাত্রছাত্রী মোটেই সুযোগ পাচ্ছেনা। এমনকি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোনো উচ্চশিক্ষার সুযোগও মিলছেনা। কিন্তু, তাদের থাকার কথা ছিলো সরকারের অন্যতম ফোকাস পয়েন্টে। কারণ গ্রামীণ উন্নয়নের কথা আসলেই যেমন আমাদের চোখে ভেসে উঠে টেকসই রাস্তা, ব্রিজ, স্কুল, কলেজ আর এর পাশাপাশি অন্যতম প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি ক্লিনিক।
সরকার একদিকে যেমন তৈরি করছে অসংখ্য কমিউনিটি ক্লিনিক কিন্তু এর কার্যক্রম কেমন চলছে তা কি দেখছে সরকার? কীভাবে চলবে ভালো কার্যক্রম যেখানে প্রাইমারি থেকে মধ্যম লেভেলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা স্যাকমোদের তাদের বেশিরভাগ পোস্টই ফাঁকা। এতে করে যেমন ভোগান্তিতে পড়েছে গ্রামীণ মানুষজন, তার বিপরীতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে যাচ্ছে ম্যাটসের শিক্ষার্থীরা।
সারা বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ম্যাটস আছে ১১টি। যেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পায়। ৩ বছরের তত্ত্বীয় পড়া এবং ১ বছরের ইন্টার্নি শেষে Diploma in Medical Faculty (DMF) সার্টিফিকেট বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ কর্তৃক প্রদান করা হয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BM & DC) কর্তৃক পেশাদার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) অনুযায়ী জনগণের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার সেবার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৬ সালে সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের অধীনে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। পরবর্তীতে এটি চার বছর মেয়াদি করা হয়। এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের কারিকুলাম অনুসরণ করে। কিন্তু বর্তমানে চার বছরের এই কোর্স শেষে থাকে না কোনো উচ্চশিক্ষার সুযোগ। থাকে না কোনো সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ।
একই রকমের কোর্সধারী ডিপ্লোমা নার্স, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার অনেকে আগেই বেতন স্কেল ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডে ভোগ করে আসছে এবং নিয়মিত চাকরির সার্কুলারও হয়। কিন্তু এদের কোনো গ্রেড পরিবর্তনও হয় না, সার্কুলারও হয় না। কেউ যদি উপার্জনের জন্য এলাকায় চেম্বার করে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে তাকে পড়তে হয় প্রশাসনের হয়রানিতে, দিতে হয় জরিমানা, যেতে হয় জেলে।
বিভিন্ন গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি এবং দেশি ও বিদেশি এনজিওগুলোর হেলথ ও নিউট্রেশন প্রোগ্রামে 'মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট' পোস্টে জব করা যায় এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন এনজিও গ্রামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেছে। এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু তা খুবই সামান্য। কিন্তু বহু বছর যাবৎ সরকারিভাবে নিয়োগ না হওয়া, মানহীন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাওয়া, উচ্চশিক্ষার সুযোগ না দেওয়া এই রকম বহু কারণে দেশে অজস্র বেকার পরিবারের বোঝা হচ্ছে এবং হতাশ জীবনযাপন করছে।
প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের জনগনের দৌড়গোড়াই কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের নিমিত্তে অনেকগুলো ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। এখানে কর্মরত থাকার কথা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (SACMO), কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), কমিউনিটি প্যারামেডিক, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী। বাকি পোস্টে নিয়োগ হলেও এর মূল পদ স্যাকমোতে কোনো নিয়োগই হয় না বর্তমানে।
তাই এসব স্থাপনার বিপরীতে পদ সৃষ্টি না হওয়ায় এবং সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান না করায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কয়েক হাজার শূন্য পদ পড়ে আছে। যেখানে নিয়োগ পাওয়ার কথা ম্যাটসের ছাত্রছাত্রীদের শুধু ইউনিয়ন ভিত্তিক না, তাদের পদ আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিয়োগ বিধির জটিলতার কারণেই গত ১০ বছর নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রায় ৫০ হাজার ডিপ্লোমা চিকিৎসক বেকার বসে আছে। আবার নতুন নতুন ম্যাটস সরকারিভাবে খোলা হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে ১১টি ম্যাটস আছে। যেখানে নেই পর্যাপ্ত জনবল। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৩৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়নি ম্যাটস ও আইএইচটি তে। যদি মেডিকেল এসিস্টেন্ট প্রয়োজন না হয় তাহলে কেন খোলা হচ্ছে নতুন করে এসব প্রতিষ্ঠান? আর কেনই বা প্রতিবছর ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হচ্ছে?
এর আগে বহুবার করা হয়েছে আন্দোলন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে স্মারকলিপি কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। শুধু আশ্বাসেই শেষ হয় সকল আলোচনা। আশা করি, এবার গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়োগ হবে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের। কমিউনিটি ক্লিনিক পাবে উজ্জীবিত হওয়ার শক্তি এবং গ্রামীণ জনগণ হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী ঝিনাইদহ ম্যাটস