৪৪ বছরের ভর্তিযুদ্ধে জয়ী সলিল, ২ কোটি টাকা দিতে হবে চমেককে

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ   © ফাইল ছবি

১৯৭৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েও ভর্তি হতে পারেননি বান্দরবান সদরের সারদা চরণ চক্রবর্তীর ছেলে সলিল কান্তি চক্রবর্তী। মেডিকেল কলেজের বাছাই কমিটি সলিল কান্তি চক্রবর্তীর এসএসসি-এইচএসসির নম্বরপত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে তাকে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে দেন।

পরে অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা এ অভিযোগ যে ভুয়া, আদালতে তা প্রমাণও হয়েছে। এমনকি এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত নির্দেশও দিয়েছিলেন তাকে ভর্তি করাতে। এরপরও ভর্তি হতে পারেননি সলিল। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেও নৈতিক অবস্থান থেকে আইনি লড়াইয়ে ছিলেন তিনি। সে লড়াইয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও পক্ষে পেয়েছেন অকৃতদার সলিল।

৪৪ বছর পর গতকাল বুধবার (০৪ মে) বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে বান্দরবান সদরের ষাটোর্ধ্ব সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা দিতে বলেছেন আপিল বিভাগ। সলিল কান্তির আইনজীবীর ভাষ্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পক্ষে অধ্যক্ষকে এ টাকা পরিশোধ করতে হবে।

আদালতে সলিলের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে এসএসসি ও ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পাসের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১৯৭৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন সলিল কান্তি। প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করার পর তিনি ওই কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন।

কিন্তু সলিল কন্তি চক্রবর্তীর এসএসসি-এইচএসসির নম্বরপত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে তাকে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে দেয় মেডিকেল কলেজের বাছাই কমিটি। সেই সঙ্গে ভর্তি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার সুপারিশ করা হয়।

এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির জন্য বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে আবেদন করেন সলিল কান্তি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে চিঠি দিয়ে জানায়, তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে তদন্তাধীন। সংস্থাটি সিদ্ধান্ত জানালে তার ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

আরও পড়ুন: আকিব থেকে সাকিব, চমেকে দুর্ধর্ষ ছাত্রলীগ

কিন্তু নম্বরপত্রসহ ভুয়া কাগজপত্র তৈরির অভিযোগে ১৯৯৪ সালের ২ আগস্ট সালিল কন্তির বিরুদ্ধে বান্দরবান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারার অভিযোগ আনা হয়।

মামলায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরপত্রসহ অন্যান্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট জাল কাগজপত্র তৈরির অভিযোগ করা হয়। পঞ্চম দফায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে মামলার অভিযোগ পত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ -সিআইডি। ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর সলিল কান্তি চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। 

কিন্তু ২০০০ সালে বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মোকসেদ আলী মামলার অভিযোগ থেকে সলিল কান্তিকে বেকসুর খালাস দিলেও তার ভর্তির বিষয়ে রায়ে কিছু বলা হয়নি। এ রায়ের পর ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সলিল চক্রবর্তীর ভর্তির সুপারিশ করে স্বাস্থ্য সচিবকে তিনবার চিঠি দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই পরিচালক।

তাতে কাজ না হওয়ায় ২০০৩ সালের ২৪ জুন মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেন সলিল কান্তি। একের পর এক এমন আবেদনের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১৭ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সলিল কান্তির ভর্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। তারপরও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ওই বছর ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে আবেদন করেন সলিল কান্তি। 

তাতেও কাজ না হওয়ায় ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান সলিল কান্তি। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে তার ভর্তির পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। এতে সাড়া না পেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন তিনি। 

রিটের প্রাথমিক শুনানির পর সলিল কান্তির ভর্তি নিয়ে রুল জারি করেন আদালত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে তাকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি করতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং তার ভর্তির ক্ষেত্রে বিবাদীদের ইচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য তাকে কেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।

চূড়ান্ত শুনানির পর ২০০৭ সালে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে রুল যথাযথ ঘোষণা করার পাশাপাশি ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে তাকে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওই বছরই হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। রায় স্থগিত থাকা অবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বুধবার (৩ মে) সে আপিল খারিজ করে রায় দিলেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে মামলার খরচ হিসেবে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। 


সর্বশেষ সংবাদ