জুলাই আন্দোলন

এখনো শরীরে ৯টি ছররা গুলি, তবু আহতের তালিকায় ঠাঁই হয়নি তা’মীরুল মিল্লাতের জুবায়েরের

জুলাই আন্দোলনে আহত জুবাইয়ের
জুলাই আন্দোলনে আহত জুবাইয়ের  © টিডিসি সম্পাদিত

১ জুলাই ২০২৪ সাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ক্যাম্পাসগুলোতে শুরু হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের শহর-নগরে। সেই ধারাবাহিকতায় ঢাকার উত্তরা এলাকার বিএনএস সেন্টারের সামনের মহাসড়কে কোটা বাতিলের আন্দোলনের শুরু। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল স্বৈরাচারী পলাতক হাসিনা সরকার। ফলশ্রুতিতে ১৬ জুলাই প্রথম গুলি করে হত্যা করা হয় রংপুরের শহীদ আবু সাঈদকে।

এরপর ১৮ জুলাইয়ের উজ্জ্বল সকালের তপ্ত রোদেই ঢাকার উত্তরা বিএনএস এলাকায় শিক্ষার্থীদের গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হয়েছিলেন গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীস্থ তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী জুবায়ের আব্দুল্লাহ। সেদিন দুপুরে ছাত্রহত্যার নির্দেশদাতা স্বৈরাচারী হাসিনার নির্দেশে উত্তরার উজ্জ্বল শান্ত সকালকে রক্তিম করে দেয় আজ্ঞাবহ পুলিশের ছোঁড়া গুলি। 

জুবায়ের আব্দুল্লাহ

সম্প্রতি আহত শিক্ষার্থী জুবায়ের আব্দুল্লাহর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে। তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার আলিম প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করেন শিক্ষার্থী জুবায়ের। সাক্ষাতে জুবায়ের জানায়, পুলিশের ছোঁড়া গোলায় তাঁর মাথা ও মুখে বিদ্ধ হয় ২২টি গুলি। একটি দাঁত ভেঙে যায়, এখনো তার শরীরে রয়ে গেছে ৯টি গুলির স্প্রিন্ট। জুবায়ের জানায়, ডাক্তাররা শুধু কয়েকটা গুলি বের করল, বাকিগুলো রেখে দিয়েছে।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এলেও কষ্ট যেন পিছু ছাড়ছে না তার। মনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেদনা, যখন দেখেন আহতদের তালিকায় তার কোনো ঠাঁই হয়নি। সহায়তার চেষ্টা করেও কিছুই পাননি, জানায় গুলিবিদ্ধ জুবায়ের। 

সেদিনের ভয়াবহতার কথা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে জুবায়ের। তবে একবিন্দু পরিমাণও বিচলিত হয়নি সেদিন। তার ভাষ্য, ১৮ জুলাই শান্তিপূর্ণ মিছিল করছি, তখনও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যাইনি, হঠাৎ করেই ওরা আমাদের ওপরে হামলা চালায়। টিয়ার গ্যাসের শেলে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, পিছু হটছিল সবাই। সেদিন কাঠফাটা দুপুরে চিৎকার করে বলেছিলাম— পেছনে হটবেন না, সামনে আসুন!

‘‘ঠিক তখনই পুলিশের ট্যাংক থেকে ছোড়া গোলা এসে মাথা, মুখ ও শরীরে আঘাত করে আমার। আমি শুধু বুঝতে পারলাম, প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি লাগল, মনে হলো মাথার ভেতর বিস্ফোরণ হচ্ছে। গরম কিছু একটা চামড়ার ভেতর ঢুকে গেল, আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম।"

তিনি বলেন, আমার সহযোদ্ধারা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে পাঠানো হয় বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও উন্নত চিকিৎসার অভাবে পরিবারের সহায়তায় গ্রামে ফিরে যায় জুবায়ের। কিছুদিন পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাকে জানানো হয়—অপারেশন করলে তার মুখে স্থায়ী দাগ থেকে যাবে।

শৈশব থেকেই জুবায়ের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। দেশের জন্য কাজ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, দাঁত ভেঙে যাওয়ার কারণে তিনি আর ডিফেন্সে আবেদন করতে পারবেন না। জুবায়ের বলেন— মা বলতেন, বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যাব। বাবা গর্ব করতেন। আজ আমি শুধু ব্যথা আর হাহাকার নিয়ে পড়ে আছি।

আলাপের এক পর্যায়ে হতাশ কণ্ঠে প্রতিবেদকের কাছে জুবায়ের জানতে চায়, আমার কী অপরাধ? আমি তো পেছনে ছিলাম না, সামনে থেকেই লড়াই করেছি।

আজ জুলাই বিপ্লবের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও তার মাথা ও মুখের ভেতরে ৯টি গুলি রয়ে গেছে, যা প্রতিনিয়ত তাকে বেদনা দেয়। রাতে ঘুমানোর সময় মাথার এক পাশে চাপ পড়লে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠেন।

জুলাই বিপ্লবের পর আহতদের জন্য জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়। জুবায়েরের বাবা দ্বীন ইসলাম অনলাইনে ফরম পূরণ করার ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো সাড়া পাননি বলে জানান। অন্যদিকে, তার মাদ্রাসায় থাকা তা’মীরুল মিল্লাত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নেতৃবৃন্দকে জানালে, বিষয়টি শোনার পরে তাঁরা কোনো সহযোগিতার আশ্বাসটুকু দেননি। অথচ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন বলে নিয়মিত দাবি ছাত্রসংসদ নামের সংগঠনটির।

জুবায়ের আব্দুল্লাহর বাবা দ্বীন ইসলাম বলেন, আমার ছেলে জুলাই বিপ্লবে সাহসী অবদান রেখেছে, যা আমাকে গর্বিত করে। জুলুম নির্যাতনের সমাপ্তি হয়েছে, ১৬ বছরের জুলুমতন্ত্রের বিদায় হওয়ায় মহান আল্লাহর শুকরিয়া জানাই। তবে আমার ছেলে আহত হয়ে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে ছিল, অথচ অফিসিয়ালি এখনো কেউ খোঁজ নেয়নি, কোনো স্বীকৃতি পাইনি।

জুবায়েরের আব্দুল্লাহর সহপাঠীরা বলছেন, জুবায়ের মতো আরও অনেক তরুণ আজ সহায়তা না পেয়ে হতাশ। অথচ প্রকৃত আহতদের জায়গায় সুবিধাভোগীরা সুযোগ নিচ্ছে। জুবায়ের আব্দুল্লাহ এর মতো সাহসী তরুণরা যদি উপেক্ষিত হন, তাহলে ভবিষ্যতে কে সামনে থেকে লড়তে চাইবে?— বলে দেশের মানুষের সমীপে প্রশ্ন রাখেন জুবায়ের ও তার সহপাঠীরা।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence