কমছে মাদ্রাসা সংখ্যা
চার দশক ধরে বেতনবঞ্চিত ইবতেদায়ী শিক্ষকরা
- সাইফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:০৭ PM , আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৩৮ PM
প্রায় চার দশক ধরে পাঠদান করেও বেতন বঞ্চিত রয়েছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ২০ হাজার শিক্ষক। ১৯৮৪ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের এ প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ক্রমেই কমেছে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা। অনেক শিক্ষক দীর্ঘকাল চাকরি করে বিনা বেতনে গিয়েছেন অবসরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে নিবন্ধন পায় ১৮ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা। পরবর্তীকালে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কমেছে এই সংখ্যা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে তিন হাজার ৮৩৯টি। অর্থ্যাৎ, মাদ্রাসা সংখ্যা কমেছে প্রায় পাঁচগুন।
১৯৯৪ সালে রেজিস্ট্রার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন মাসিক মাত্র ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। এভাবে একই ধারায় চলতে চলতে থাকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ও রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি সরকার ২৬ হাজারের বেশি রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করলেও উপেক্ষিত থাকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো।
আরও পড়ুন: মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়াতে অধিদপ্তরের ৩ নির্দেশনা
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান, ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র মাদ্রাসার শিক্ষকদের মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা নির্ধারণ হয়। এরপর ২০১৩ সালে শিক্ষকদের ভাতা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়। পরের বছর মহার্ঘ্যভাতা হিসেবে ২০০ টাকা যোগ করে সর্বমোট ১২০০ টাকা দেওয়া হয়। আর ২০১৭ সালে সেই ১ হাজার ৫১৯টি পুরাতন মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের মাসিক ভাতা ২৫০০ টাকা ও ইবতেদায়ী সহকারীদের ২৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চলমান তিন হাজার ৮৩৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক। তবে, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে ৭ হাজার ৪৫৩ টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা চলমান রয়েছে। সে হিসাবে এসব মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
জানা গেছে, শিক্ষকরা বোর্ডের অনুমতি পেয়ে কয়েক যুগ ধরে পাঠদান করে আসছেন। কিন্তু বেতন-ভাতার মুখ দেখা হয়নি তাদের। প্রাপ্য সম্মান না পেয়েই অনেক শিক্ষক অবসরে গেছেন। শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
কয়েকজন শিক্ষক জানান, বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে বঞ্চিত করে মাত্র ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার সাড়ে চার হাজার শিক্ষককে ২৩০০ ও ২৫০০ টাকা হারে নাম মাত্র অনুদান দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে মাদ্রাসাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে কোনো অনুদান দেওয়া হয়নি। এমনকি যে ১০ হাজার ইবতেদায়ী মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা উপবৃত্তি পেত তাও ২০২১-২২ অর্থবছরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, নতুন/পুরাতন এবতেদায়ী মাদ্রাসার রেজিষ্ট্রেশন/নবায়নও বন্ধ করে দিয়েছে মাদ্রাসা বোর্ড।
আরও পড়ুন: হাফেজ শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিলো তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা
জানা যায়, বেতনের দাবিতে কয়েকদফায় আন্দোলন করেছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা। আন্দোলনে বারবার প্রতিশ্রুতি মিললেও বেতন মেলেনি এই শিক্ষকদের। সবশেষ বেতন বৈষম্য নিরসনসহ স্বতন্ত্র মাদ্রাসা সরকারিকরণের দাবিতে ২০১৮ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন করেন কয়েক হাজার শিক্ষক। সরকার তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষকরা বাড়ি ফিরে যান। এরপর স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য ‘এমপিও ও জনবল কাঠামো নীতিমালা-২০১৮’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নীতিমালাটি আজও কার্যকর হয়নি।
আমিনুল ইসলাম নামের এক শিক্ষক জানান, কতৃপক্ষ ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাদের অবহেলার কারণে মাদ্রাসার সংখ্যা কমছে। শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা না হলে আগামীদিনে এধরনের মাদ্রাসা থাকবেই না। তিনি ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করনের দাবি জানান এবং এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে, অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলো পরিচালনায় কর্তৃপক্ষ উদাসীন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক রবিউল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষকতা করছি। আমার মাদ্রাসার মোট চারজন শিক্ষকের নামে অনুদান আসে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন, একজন অন্যত্র চাকরি করছেন। বারবার এমপিও সংশোধনির আবেদন করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের নামেই অনুদান আসছে। অথচ আমরা যারা পরে চাকরিতে যোগদান করেছি তারা অনুদান পাচ্ছি না।
‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। গত ৮ ডিসেম্বর শিক্ষাবোর্ডের একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য ৩২টি উপজেলার ১২৮টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগে পদ বাড়ছে ৫ হাজার
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান কাজী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ে স্ট্যাডি করছে। এজন্য একটি গবেষণা কর্ম শুরু হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।’
এই গবেষণার পর কী হতে পারে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আশাবাদী আমাদের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ হবে। আমরা গত অক্টোবর মাসে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছি।’
‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা’-এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সমীক্ষার শুরুর দিকের কাজগুলো করছি। কোন উদ্দেশ্যে সমীক্ষা করা হচ্ছে সেটা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ভালো জানে। সমীক্ষার কাজ শেষ হলে হয়তো এ বিষয়ে বলা যাবে। তবে, এ ধরনের সমীক্ষার উদ্দেশ্য থাকে একাধিক পলিসি। এর ভিত্তিতে সরকারের যেকোনো পলিসি বাস্তবায়ন হতে পারে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে দুই ধরনের ইবতেদায়ী আছে। কিছু মাদ্রসার শিক্ষকরা অল্প কিছু অনুদান পান। আর কিছু মাদ্রাসার শিক্ষকরা অনুদান পান না। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি সমীক্ষা করছি। এই সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে।
মাদ্রাসাগুলো এমপিওভুক্ত হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, আপাদত শিক্ষকদের সুযোগ বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে। এমপিওভূক্তি কিংবা জাতীয়করণের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য পৃথক কোনো বাজেট নেই। কাজেই এই মাদ্রাসাগুলোর শীঘ্রই এমপিভুক্তি বা জাতীয়করণ সম্ভব নয়। পরে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।