মেয়েটির নাম জারুল

মুনশি আরাফাত হোসাইন
মুনশি আরাফাত হোসাইন  © সংগৃহীত

আজ মিডটার্ম। পরাক্রমশালী শাওন স্যারের ইনভেস্টমেন্ট কোর্সের মিড। নির্দয়তার জন্য ডেপ্টে তার খ্যাতি অনেক। বোধহয়, পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ জীবনে গুটি তিনেক হাসি দিয়েছেন। ভার্সিটি লাইফের ২৪ মাসে কেবল একবারই উনার একটি মুচকি হাসি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আর কখনো সে সৌভাগ্য হয়নি। ক্লাস কিংবা এক্সাম হল, স্যারের প্রবেশ মানেই পরিবেশ থমথমে। সিরাজ উদ দৌলা নাটকে দেখেছিলাম, নবাব সিরাজ উদ্দৌলা যখন দরবারে প্রবেশ তখন দরবারের একজন বরণ করে নেয়ার জন্য অনেক উপাধি বলতো। তারপর দরবারে যে নিস্তব্ধ ও ভীতিকর পরিবেশ সেই পরিবেশ সৃষ্টি হতো শাওন স্যার প্রবেশের সময়, যদিও কোন কর্মচারী স্যারের আগমনী বার্তার কীর্তন করে না তবুও শিক্ষার্থী, কর্মচারী এমনকি অন্যান্য শিক্ষকরাও ভয়ে বা শ্রদ্ধায় তটস্থ থাকে সচরাচর। একটি ক্লাস মিস দেয়ার দুঃসাহস তো দূরের কথা, ৫ মিনিট লেট করে ক্লাসে ঢুকলে, আপনি সেদিনসহ পুরো কোর্সে আর কোন অ্যাটেন্ডেন্স পাবেন না।

বেশিরভাগ পাপীষ্ঠরা নানা তদবির করে রেহায় পেলেও গুটি কয়েক পাপিষ্ঠরা স্যারেরর রেড লিস্টে থাকতোই। তারা মিডে বসতে পারতো না। এক্সাম হলে গিয়ে, তদবির করার সময় স্যারের সেই চিরচেনা ডায়লগ, ‘কিক মেরে ১০ তলা থেকে ফেলে দিবো’। মাথা নিচু করে ক্লাস ছাড়া ব্যতিত আর কোন অপশন থাকে না দাগী আসামীদের। তা-ও হল ত্যাগ করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৬০-১২০ সেকেন্ড। পই পই করে হিসেব করে প্রশ্নের সেট নিয়ে আসতো, একটা বেশীও না কমও না। যাতে করে পাপিষ্ঠ দলের কেউ কোন রকমেই পরীক্ষা দিতে না পারে। কোয়েশ্চেন স্ক্রিপ্টেই উত্তর দিতে হবে। এক ইঞ্চি জায়গাও বেশী দেয় না, শাওন স্যারের এমন কীর্তি দেখলেই আমার এলাকার স্টেশনের যে পাব্লিক টয়লেট, সেটার কথা মনে পড়ে যায়। আশেপাশে কতো জায়গা, বাট টয়লেটে এক ইঞ্চিও এক্সট্রা জমি নাই। ১০ টাকা দিয়ে ঢুকবা, এদিক সেদিক লড়াচড়া করা যাবে না। যাইহোক শাওন স্যারের সাইকোলজি পোস্ট মর্টেম করাটা আমাদের গল্পের মূল বিষয়বস্তু না।

বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে না আবার ইলশেগুঁড়ি ও না। মধ্যম ধাঁচের তবে দারুণ ছন্দে। উদাহরণ যদি বলি পপ গানের মতো তীব্রও না আবার রবীদ্র সংগীতের মতো মৃদুও না। ঠিক যেন নুসরাত শাহের কাওয়ালী যতই সময় গড়াচ্ছে ততই গাঢ় হচ্ছে ছন্দ। আকাশটা মেঘে অন্ধকারাচ্ছন্ন যদিও তখন দুপুর ১২ টা। কথায় আছে, বৃষ্টি প্রেমকে দ্বিগুণ করে আর বিরহকে দশগুণ। তবে আজকের বৃষ্টিতে আমি কোন বিরহের ছাঁপ দেখতে পাই নি। যতদূর দেখেছি ততদূর শুধু প্রেম, প্রেম আর প্রেম। হতে পারে আর হৃদয়ের মোহ, তবুও আজকের বৃষ্টির ছন্দে কোথাও আমি বিরহ দেখতে পাইনি। মেঘ আর সূর্যের সম্পর্ক সাপে নেউলে। তবু সেদিন তাদের মাঝে যে প্রথাবিরোধী ভাব দেখে, আমি কিছুটা হতবিহ্বল হলেও একটা অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করলাম। ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, গোত্রে-গোত্রে, বর্ণে-বর্ণে সহ মানুষের মাঝে যত কৃত্রিম ব্যবচ্ছেদ, মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা একদিন হয়তো প্রেমশক্তি দিয়েই সবকিছুকে এক ও অবিচ্ছেদ্য করে গড়ে তুলবেন। আজ, কাল কিংবা হাজার বছর পরে একদিন না একদিন তিনি সেই অমোঘ প্রেম সকলের মাঝে জাগ্রত করবেনই করবেন।

ঘড়িতে ঠিক ১১ টা বেজে ৫০। মেয়েটি বরারবরের মতোই এক্সাম হলে প্রবেশ করলো। পরিবেশটা সুনসান নীরব, যেহেতু পরীক্ষাটা শাওন স্যারের। কিন্তু সকল নীরবতার বাঁধ ভেঙ্গে, আমার হৃদয় কথার পর কথা দিয়ে কথার পসরা সাঁজাচ্ছে। কি অদ্ভুত! চেহারায় আমাকেও ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে অথচ হৃদয়ে উচ্ছ্বাস। তখন মনে হলো, জন্মের পর মানুষের মস্তিষ্ক দিনকেদিন ম্যাচিউর হলেও হৃদয় যেন ব্যাকরণের অব্যয় কিংবা গণিতের কনস্ট্যান্ড। মস্তিষ্ক দেহের সবকিছু শাসন করতে পারলেও হৃদয়টা শুধু পারে না।পারলে হয়তো এমন কঠিন মুহুর্তে হৃদয় কথা বলার সাহস পেতো না। যাইহোক সে মেয়েটাকে নিয়ে এতো দর্শনচিন্তা সে মেয়েটার সম্পর্কে হালকা ধারণা দেয়া যাক।

গাঁয়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ঠিক দুপুরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ জুড়ে আলো ও আঁধারের মিথস্ক্রিয়ায় যে রঙ প্রকৃতি যে রঙ্গে সেঁজেছে,ঠিক যেন হুবহু মেয়েটিরই গাঁয়ের রঙ। মাথায় চুল অনেক,মোটামোটি কোমড় পর্যন্ত যদিও আজ খোঁপা করা,সবসময় তাকে হালকা মেক-আপেই দেখেছি, পোশাক ৯০ দশকের শিক্ষিত মেয়েদের রুচিবোধের প্রতিচ্ছবি যদিও চিন্তা ও মননে আধুনিক মনে হয়েছে। জামদানি শাড়ির প্রতি বোধ করি আলাদা একটা ভালোবাসা আছে। শুনেছি তুখোর মেধাবী। মেধার একটা মৃদু অহংকার আছে, যতটুক দেখেছি নিরহংহার মনে হয়েছে,আবার থাকতেও পারে তবে সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রথাগত নারীর চেয়ে একটু আলাদা এই অর্থে বলবো, নিজের দুর্বলতা সাবলীলভাবে প্রকাশ করে, নিজের রুচিবোধের সাথে কখনোই আপোষ করে না মানে বাঙালী নারীর মতো অনুকরণপ্রিয় না। ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা আছে, তবে ধর্মান্ধতা কিংবা সংস্কৃতির প্রতি অন্ধভক্তি নেই।

মেয়েটি তার পূর্বনির্ধারিত আসনে বসলো। সীট জানলার পাশে না। তবুও আজকের মোহময় বাতাস আলতোভাবে তার কেঁশ ছোঁয় আবার হারিয়ে যায়,আবার ছোঁয় আবার হারায়। বাতাস মেয়েটির সাথে হয়তো লুকোচুরি খেলতে চাচ্ছে কিন্তু  মেয়েটিকে হয়তো বলতে না বোঝাতে পারছে না। মেয়েটি নোট পড়ছে তো পড়ছেই। খোঁপা থেকে কয়েকটি চুল কপালে আঁচড়ে পরছে। চুল এই খোঁপা স্পর্শ করলো তো এই চোঁখ। এসবের দিকে মেয়েটির খেয়াল নেই,তার সমস্ত খেয়াল তার নোট খাতায়। রীতিমতো এক্সাম শুরু হলো,বাতাসও তাকে বিরক্ত করা কমালো,তবে মায়েরা যেমন সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মাথায় সিঁথি কাটে,বাতাসও মেয়েটির চুলে এমন করে পুরো এক্সাম টাইমটা সিঁথি কেটে গেলো! যেই বাতাসকে এতোদিন সাম্যোর প্রতীক হিসেবে জেনেছি, তাকে আজ জানলাম ভিন্ন পরিচয়ে। আসলে সুন্দর সর্বকালে,সর্বজনে পূজনীয়। এটা অসাম্য হলে অসাম্য; তবে সত্য এটাই। যাইহোক আমাকে বাতাস হয়তো মন্ত্র টন্ত্র বলে, বশ করে নিয়েছে নয়তো শত চেষ্ঠা করেও বাতাসের বায়াসড আচরণের জন্য বিপ্লবী হতে পারলাম না।

যথারীতি পরীক্ষা শেষ হলো। সবারই মোটামেটি ভালো হয়েছে। শাওন স্যার নির্দয় হলেও পড়ায় ভালো। কনসেপ্ট চমৎকার ব্যাখা করে, থিওরির সাথে ম্যাথের যোগসাজশের রসায়ন বোঝাতে তার জুড়ি মেলা ভার। যা পড়ায় তাই কোয়েশ্চেন করে। একেবারে টু দ্য পয়েন্ট। যেহেতু আজ বৃহস্পতিবার পরপর দুইদিন পর নেক্সট পরীক্ষা তার উপর এই চমৎকার ওয়েদার, তাই সবার মনই প্রকৃতি প্রেমে কিছুটা উতলা হয়ে উঠলো।

মেয়েটিকে দ্বিতীয়বারের মতো আবিষ্কার করলাম ৮ তলায়। সেখানে দুহাত ছেড়ে,চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রথমবার যেটা মনে হয়েছিলো, মেয়েটি পাষাণ কিংবা স্বার্থপর বাতাসের সাথে অবিচারের দরুন। সেই মেয়েটিকে এমন অবস্থায় আবিষ্কার করে টাস্কি খেলাম। বলতে গেলে বলদ বনে গেলাম। আমার ধারণা এক্মাম হলে বাতাসের সাথে মেয়টির কথা হয়েছে। বাতাসকে হয়তো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে বলেছে এবং বাতাস তা মেনে মনের সুখে সিঁথি কাটছিলো। তখন বোঝতে পেরেছি ভাবের জগতটাই আলাদা। নীরবতাই প্রেমের ভাষা। তখন নিজেকে বললাম, আদাঁ ব্যাপারি জাহাজের খবর নিয়ে করবি কি!

দৈবক্রমে আবার মেয়েটি তৃতীয়বারের মতো আবিষ্কার করলাম লিফটের নিচে। মেয়েটির সাথে বারংবার দেখা হোক, এই ইচ্ছা থাকলেও, দেখা করার জন্য ন্যূনতম প্রয়াস করে নি। তবু হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি তার বান্ধবীর সাথে হাসছিলো তার ঠিক পিছন কোণে আমিসহ আমার ২ বন্ধু দাড়ানো। হঠাৎ একটা স্ফীত হাসি আমার কানে আসলো,পিছন ফিরে দেখি হাসিটা ঐ মেয়ের। অপরিচিতা গল্পে কল্যাণীর কন্ঠকে রবী  ঠাকুরের কাছে যেমন অমৃত গানের ধূয়া হয়েছিলো,আমার কাছে এমন না হলেও কাছাকাছি তো বটেই। এটার হয়তো একটা কারণ আছে একই ব্যাচে পড়লেও তার কন্ঠ ঐভাবে কখনো শোনে নি। কোনকিছুর অপেক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে একসময়  অপেক্ষা হতে প্রাপ্তি অমৃতই মনে হয়। এটা যে শুধু প্রেমের ক্ষেত্রে না নয় সর্বক্ষেত্রেই। 

অতপর মেয়েটি প্রকৃতির অনুরোধেই হয়তো তার খোঁপা ছেড়ে দিলো। সীতাকুন্ডের পাহাঢ় থেকে ঝর্ণা পরার সময় যেভাবে বাতাসে ঢেউ খেলে ঠিক মেয়েটার চুলগুলিও বাতাসে তেমন ঢেউ খেলছে। তার হাসিটা শরতের কাঁশের মতোই মোলায়েম। 

অবশেষে প্রস্থানের সময়। আমি ঠিক ছাঁউনির নিচে দাড়িয়ে। মেয়েটি ছাঁতা খোলে ধীরে ধীরে এফবিএসের গেটের দিকে এগোচ্ছে। আমার কাছে মনে হলো ছাঁতাটা কোন এক চিল চুরি করে নিলো। উন্মুক্ত চুলে ছোট ছোট বৃষ্টির ফোটা পরছে। কয়েকটি ফোটা মিলে একটা জারুল ফুলে পরিণত হচ্ছে। একটা ফুটছে,দুইটা ফুটছে অতপর যেনো বৃষ্টির প্রতিটা ফুঁটায় জারুলের দখলে। মেয়েটি আরো দূরে চলে যাচ্ছে, আমার চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। একসময় মেয়ের পড়নের বেগুনি রঙের কামিজটিকে মনে হলো ভিসি চত্বের রাস্তা পাশের সেই জারুল গাছটা। মেয়েটি তখন আমার চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলো,তখন কে যেনো জিগ্যেস করলো, ‘কিরে কি দেখিস?’ আমি বল্লাম ‘জারুল’। সে বললো ‘কীসের জারুল?’ আমি বললাম ‘মেয়েটির নাম জারুল’।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence