ছোট গল্প: মেহেরুন
মেহেরুনের এখন প্রতীক্ষা শুধু মৃত্যুর-কাফনের
- নূরজাহান শিল্পী
- প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০১:০৫ PM , আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০১:০৫ PM
কাক ডাকা ভোর খুব পছন্দের মেহেরুনের। যদিও জীবনের সব তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো এই ভোরেই সংগঠিত হয়েছে তার জীবনে। সৃষ্টিকর্তার সমর্পণে যখন সমস্ত সৃষ্টি তখন কমলা রঙের আলোয় এক অপার্থিব জ্যোতি ছড়ায় পৃথিবীর ছায়া যেন নেমে আসে মেহেরুনের আঁচলে।
বাবা পাকিস্তানি, মা বাংলাদেশী। জন্মসূত্রে পাকিস্তানি মেহেরুনের স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে। ভালোবাসার বিয়ে ছিল বাবা-মায়ের। মায়ের জন্য বাবা নিজ দেশ ত্যাগ করে এসেছিলেন। আর এদিকে দুই বছরের মেহেরুনকে নিয়ে
সেই মা পালিয়ে গেলেন পাশের বাড়ির চাচাতো ভাইয়ের সাথে।
মেহেরুনের বয়স যখন ৫ সেদিনও ছিল কাক ডাকা ভোর। প্রকৃতির ডাকে মেহেরুন জেগে ওঠে মাকে খুঁজতে খুঁজতে অবুঝ মানে বুঝে গিয়েছিল ‘কোন এক অশনি সংকেত’। সেই মেহেরুনকে বাবা কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন।
১৬ বছর বয়সে সেই এক কাক ডাকা ভোরে পাকিস্তানিরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে, শারীরিক নির্যাতনে জর্জরিত মেহেরুন কীভাবে পালিয়ে এসেছিল মনে করতে পারে না এখন আর। আশ্রয় নিয়েছিল ছোট্ট এক বিধবার কুঠিরে।
তারপর শুনলো বাবা পৃথিবীতে বেঁচে নেই।
শূন্য ভিটায় ফিরে না গিয়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে চলে গেল শহরে। আশ্রয় মিললো পতিতালয়ে। শরীর যখন উড়তে লাগলো মন মরে গেল, ডানা কাটা পাখির মত আহত মেহেরুন প্রতি রাত অপেক্ষা করে কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণের। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এক শহরে বাবুর চোখে মনে আগুন লেগে মুছে গেল মেহেরুনের কলঙ্ক। সংসার হলো আশ্রয় হল কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তান।
আরও পড়ুন: আমরা কবে মানুষ হবো?
নূরজাহান শিল্পী
মোটামুটি অবস্থা সম্পন্ন পরিবারে সুখে-শান্তিতেই মেহেরুনের দিনাতিপাত চলছিল। হঠাৎ স্বামী মারা গেলেন, পরিবারের বাকি সদস্যরা মেহেরুনকে আশ্রয়হীন করে দিল। পুত্র সন্তানকে নিয়ে সেই এক কাক ডাকা ভোরে দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হল
সেই পতিতালয়।
মেহেরুনের জীবন ছেলেকে ভালো স্কুলে লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব কিছুই করলো। ভার্সিটিতে পড়াকালীন ছেলের সম্পর্ক হল উচ্চবিত্ত পরিবারের এক মেয়ের সাথে। মেয়ের বাবা বলে দিলেন, ছেলে তার মায়ের সাথে যদি সম্পর্ক রাখে তাহলে মেয়ে দেবেন না। ভালোবাসার টানে ছেলেটা মাকে বলল তুমি এখানেই থাকো, আমি আমার নতুন জীবন শুরু করি।
মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসবো।
মেহেরুন শুনেছেন ছেলেটার একটি মেয়ে হয়েছে। প্রতি রাত বুকের ভেতর ছেলেটার ফেলে যাওয়া কাপড়ের ঘ্রাণ মাখেন আর বলেন ‘বাবা একটিবার তোর মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছে করে। যদি মরে যাই আমি কি আমার নাতিনের মুখটা দেখবো না?’
ছেলে সেই যে গিয়েছিল আর কখনো মায়ের খবরও নেয়নি। কিভাবেই নেবে? বাবা বলতেন আমার মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ মেহেরুন কোথায়? কোথায় তার আশ্রয়? জীবনের এই অন্তিম যাত্রাপথে কেউ নেই তার সহচর। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শরীর চোখ বসে গেছে, কুঠুরিতে ছানি পড়েছে। এখানে দুইবেলা খাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না মেহেরুনের। দয়া করে একবেলা ওরা খেতে দেয় এটুকুই বা কম কি?
শেষ যখন ছেলের সাথে দেখা হয় শুধু একটা অনুরোধ করেছিল, বাবা যদি শুনিস কখনো আমি মরে যাই—তোর হালাল রুজির টাকা দিয়ে আমার কাফনের কাপড়টা দিস বাবা; মাতৃদুগ্ধের এই ঋণটুকু শোধ করিস বাবা।
ভেতরটা হাহাকার করে উঠে মেহেরুনের, চোখের জল শুকিয়ে গেছে সেই কবে। এখন আর জল আসে না। এখন শুধু প্রতীক্ষা মৃত্যুর এখন প্রতীক্ষা কাফনের। এখন প্রতীক্ষা শেষ অন্তরাত্মায় একবার ছেলেকে দেখার।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী