৫ আগস্ট : হাসিনার পতনের দিন যা ঘটেছিল
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৬ AM , আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০২:৫৯ PM
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর ৫ আগস্ট চলছিল আন্দোলনের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ও সরকারের ডাকা অনির্দিষ্টকালের কারফিউ। একইসঙ্গে সরকার ৫–৭ আগস্ট তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এই প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সকাল থেকেই কারফিউর মধ্যে রাজধানীতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করলেও, হঠাৎ ঢাকামুখী জনস্রোতের একপর্যায়ে দুপুরে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। এরপরই শহরজুড়ে শুরু হয় বিজয়ের মিছিল।
দুপুরের পর ঢাকার পথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হেলিকপ্টারে দেশত্যাগের ভিডিও।
দুপুরের দিকে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর জানায়, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। এএফপি জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।

এরপরই জনতার ঢল ঢুকে পড়ে গণভবনে। নিরাপত্তাবাহিনী তখন আর সেখানে ছিল না। শুরু হয় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর। সংসদ ভবনেও ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা। সেখানেও আগুন জ্বালানো হয়। ধানমন্ডির সুধা সদন ও শেখ মুজিবরের স্মৃতি জাদুঘরে চালানো হয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। একইভাবে ভাঙচুর করা হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয় ও জেলা কার্যালয়গুলোতেও। গুলিস্তানের পুলিশ সদর দফতর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান অবনতিতে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান সেনানিবাসে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, সব হত্যার বিচার হবে, সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিকেলে একটি ভিডিও-বার্তায় বলেন, সেনাপ্রধান ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষা বুঝেছেন এবং বড় সুসংবাদ আসছে। তিনি ছাত্রদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। একই আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর জানায়, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। এরপর রাতে জানানো হয়, পরদিন থেকে সব অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে।

কিশোরগঞ্জে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাসভবনেও হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ৫ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দির মুক্তি দাবি করেন এবং অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করার কথা জানান। একইসঙ্গে শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণা এবং রাজপথে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
রাতেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে খালেদা জিয়ার মুক্তির সিদ্ধান্তও হয়।
এরপর রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দ্রুত সাধারণ নির্বাচন আয়োজন, বন্দিদের মুক্তি, শহীদদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, এবং আহতদের চিকিৎসাসহ সব দাবি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার ঢেউ ওঠে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজ বাসভবনে নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। শেখ হাসিনা ভারতের গাজিয়াবাদ ঘাঁটিতে পৌঁছে অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, শেখ হাসিনা রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন।
এদিকে ৫ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিক্যালে ৪০টি মরদেহ পাওয়া যায়। এদিন যশোরে আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেলে আগুনে ২৪ জন নিহত হন। কয়েকটি গণমাধ্যম কার্যালয়েও হামলা ও ভাঙচুর হয়। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের খবর পাওয়া যায়। কয়েকটি কারাগারে হামলা চালিয়ে বন্দিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ঘটনার মধ্যেই রাজনৈতিক সমঝোতার পথে এগোয় জাতি। অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা, হত্যার বিচার, সকল পক্ষের অংশগ্রহণ ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের আশ্বাস নিয়ে নতুন এক সময়ের দিকে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ।