শহরের রাজপথে তিন তরুণের রক্তে লেখা ইতিহাস, মাহবুব, সৌরভ ও সবুজ হত্যার এক বছর
- আরফান আলী, শেরপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:০৪ AM , আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০২:১৬ PM
৪ আগস্ট ২০২৪—বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিন। কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে দেশব্যাপী চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ের মুখে প্রশাসনের সহিংস হামলায় নিহত হন শেরপুরের তিন তরুণ—মাহবুব আলম, সারদুল আশীষ সৌরভ ও সবুজ। সময় পেরিয়েছে এক বছর, কিন্তু আজও বিচার হয়নি এই তরুণদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের।
মাহবুব: শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন
শেরপুর সদর উপজেলার তারাগড় কান্দাপাড়া গ্রামের মাহবুব আলম ছিলেন শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বয়স মাত্র ১৯ বছর। আইটি ল্যাব নামের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালাতেন বন্ধুদের সঙ্গে। পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন নারীদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্পেও।
৪ আগস্ট সকালে ‘কলেজে যাচ্ছি’ বলে বাসা থেকে বের হন মাহবুব। কিন্তু কলেজে আর পৌঁছাননি। খরমপুর মোড়ে ছাত্রদের বিক্ষোভে যখন প্রশাসনের গাড়ি উঠে যায়, তখন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। তার বড় ভাই মাজহারুল বলেন, আমার ভাই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল না। শুধু শিক্ষার আলো ছড়াতে চাইত। তার মৃত্যু ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড।
সৌরভ: সমাজসেবায় নিবেদিত প্রাণ এক তরুণ
সারদুল আশীষ সৌরভ (২২) ছিলেন শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের সন্তান। সেকান্দার আলী কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। সমাজসেবায় ছিল অদম্য আগ্রহ—গরিবদের জন্য চাঁদা তোলা, ঈদে খাদ্য বিতরণ, গণকবরস্থান উন্নয়নে নেতৃত্ব—সবই করতেন একাই। মিছিলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি উঠিয়ে দিলে রাজপথেই নিথর হয়ে যান সৌরভ। তার বাবা মো. সোহরাব হোসেন বলেন, ছেলেটা সারাক্ষণ মানুষের উপকার করত। আজও যারা তাকে মেরে ফেলল, তারা বহাল তবিয়তে আছে। এটাই কি বিচার?
সবুজ: দরিদ্র পরিবারের ভরসা, হারিয়ে গেল স্বপ্ন
শ্রীবরদী উপজেলার রুপারপাড়া গ্রামের সবুজ ছিলেন এক দরিদ্র পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্যারালাইজড বাবা ও মা-বোনদের মুখে খাবার তুলে দিতে কাজ করতেন স্থানীয় ফার্মেসিতে। সেই সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন পড়াশোনা। এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মানবিক বিভাগ থেকে। ৪ আগস্ট মিছিলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে প্রাণ হারান সবুজ। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, পেয়েছেন জিপিএ ৪.৩৩। মা সমেজা খাতুন বলেন, সকালে বলল, ‘ভাত রান্না করো, ফিরে এসে খাব।’ কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
মাহবুব ও সৌরভের মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী শেরপুর জেলা প্রশাসনের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলাম শাকিল (৪১তম বিসিএস)। তরিকুলের নির্দেশেই চালক হারুনুর রশীদ গাড়ি উঠিয়ে দেন ছাত্রদের মিছিলে। প্রাণ হারান মাহবুব ও সৌরভ। একই দিনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে প্রাণ হারান সবুজ।
তাদের পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্ত কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় আছেন তারা। তিনজনই ছিলেন শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার, সমাজসেবী—স্বপ্ন বোনা তরুণ। রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় তাদের স্বপ্ন থেমে গেল একদিনেই। এদিকে মাহবুবের স্মরণে গড়ে উঠেছে ‘শহীদ মাহবুব আলম মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। তবে পরিবারগুলোর একটাই দাবি—সত্যের বিচার।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে শুরু হয় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করতে চাইলে আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দলটির প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
৪ আগস্ট এখন আর ক্যালেন্ডারের একটি দিন নয়—এটি হত্যাকাণ্ডের দিন, প্রতিবাদের দিন, বিচারহীনতার দিন। মাহবুব, সৌরভ ও সবুজ শুধু তিনটি নাম নয়—তারা হয়ে উঠেছেন এই প্রজন্মের প্রতিবাদের প্রতীক। তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, এই প্রত্যাশাই আজ দেশবাসীর।