নারী দিবস চাই না, চাই একটা মানুষ দিবস

  © টিডিসি ফটো

বলছি একজন সফল নারীর গল্প। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট ড. লায়লা খালেদা। শিক্ষকতা ও গবেষণার বাইরে অবসরে বই পড়েন। কাজ করেন সমকাল সুহৃদ, সায়েন্টিফিক সোসাইটির সাথে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নানা প্রসঙ্গে দ্যা ডেইলি ক্যম্পাসের সঙ্গে কথা বলছেন ড. লায়লা খালেদা। তাঁর সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশটুুকু নিচে তুলে ধরা হল—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন নারীর সফলতার মূলে কোন অনুষঙ্গগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে? সেক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা কতখানি দরকার বলে আপনি মনে করেন?

ড. লায়লা খালেদা: প্রথমেই ধন্যবাদ জানায় যে এরকম সুন্দর একটা দিনে এই বিষয়টা নিয়ে ভাববার এবং প্রশ্ন করবার জন্য। একজন নারীর সফলতার জন্য তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অনেক বড় প্রভাবক। সেক্ষেত্রে তার পরিবার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। ছোটবেলা থেকে যদি পরিবারের সহযোগিতা না পায় তাহলে কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাটা থেকেই বঞ্চিত হয়। একজন নারী যদি শিক্ষিত না হয় তাহলে তার যে অধিকার রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সে জানতে পারে না, সচেতন হতে পারে না। পরিবার যদি তাকে ছোট থেকে এটা বলে চেপে রাখে যে, তুমি শুধুই নারী, তুমি শুধুই মেয়ে, তোমার কাজ শুধুই ঘরের ভেতর। এই দেশের জন্য, সমাজের জন্য সে যে অবদানটা রাখতে পারতো সেটা পারবে না। পারিবারের, বাবা-মার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার আজকের সফলতার পেছনে অবশ্যই বাবা-মায়ের ভূমিকা রয়েছে। তাদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

ড. লায়লা খালেদা: বাবা-মায়ের কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে। এই ছোট বয়সে যতটুকুই আসতে পেরেছি এর পুরোটাই আমার পরিবারের, শিক্ষক-শিক্ষিকার অবদান। আমার মা অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। আমার বাবা একাধারে রাজনীতিবিদ ছিলেন, সমাজ-সেবক এবং মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আমার চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদে মনে হয়নি যে আমি মেয়ে। আমাকে তারা সন্তান হিসেবে মানুষ করেছেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার জন্মস্থান, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

ড. লায়লা খালেদা: আমার জন্ম নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়েছি ওখানেই। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছি ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে করেছি, যেহেতু জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ তখনও শুরু হয়নি। এমফিল করেছি চবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে। পিএইচডি করেছি দক্ষিণ করিয়া থেকে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ছেলেবেলার কোনো মধুর স্মৃতি, যা আপনাকে আজও আলোড়িত করে। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

ড. লায়লা খালেদা: আমি যখন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে তখন আমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন আমার বিয়ে দেওয়ার কথা শুরু হয়। যেহেতু সংসারে ছেলে নেই (৩ বোন), একটা ছেলে আসবে, এসে সংসারের হাল ধরবে। একটা সময় আমার মাও আত্মীয়স্বজনের কথায় প্রভাবিত হয়ে যান। তখন আমার অসুস্থ বাবা বলেছিলেন, আমার মেয়েকে তো আমি মেয়ের মতো মানুষ করিনি, একজন সন্তান হিসেবে মানুষ করেছি, একজন ছেলের মতোই। এখন আমি অসুস্থ, তবে সে যদি পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। তাহলে তার যোগ্য জিনিসটা সে খুঁজে নিতে পারবে। এই জিনিসটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। বাবার অনুপস্থিতিতে আমি বিদেশে গিয়ে পিএইচডি করে এসেছি। আমার বাবা সব সময় বলতেন, আমার মেয়ে বিদেশে যাবে পড়ালেখা করতে আমি তাকে এয়ারপোর্টে আনতে যাবো। এখন যতোবারই এয়ারপোর্টে যাই আমার বাবার কথা মনে হয়। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস:  আপনার অবসর কীভাবে কাটে, আপনার শখ ইত্যাদি সম্পর্কে যদি বলেন?

ড. লায়লা খালেদা: প্রথম কথা হলো, অবসর নেই! প্রশাসনিক দ্বায়িত্বের বাইরে আমার যে মূল জায়গা, আমার ক্লাস বা গবেষণা, এখানে আমি সব সময় সম্পৃক্ত থাকতে চাই। একজন শিক্ষক যদি গবেষক না হতে পারেন তিনি কখনও পুরোপুরি শিক্ষক নন। আর গবেষণাটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। গবেষককে সর্বশেষ তথ্যগুলো জানতে হয় এবং সেগুলো ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে যুক্ত অনেকগুলো শাখায় আমার প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। একাধারে আমি অটিজম, আর্সেনিকের যে ভয়াবহ অবস্থা এসব নিয়ে কাজ করছি। সম্প্রতি, চবিতে গ্রিন হাউজ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ছিলাম। আমি সবসময় কাজের সাথে থাকতে চাই। তবে সুযোগ পেলে বিভিন্ন রকমের বই পড়তে পছন্দ করি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জকভাবে ক্রমেই বাড়ছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. লায়লা খালেদা: সেক্ষেত্রে বলবো, আমাদের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু গুণগত মান বাড়ছে না। শুধু বড় নেতার হাত ধরে আসলে বা প্রলোভনে পড়ে আসলে, দ্বায়িত্ব সম্পর্কে জানা না থাকলে, সমাজের তো নয়ই তিনি যে দলের জন্য এসেছেন তারও কোনো উন্নয়ন হবে না। সুযোগ-সুবিধার জন্য রাজনীতিতে আসলে হবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আপনি দায়িত্ব পালন করছেন। এই অবস্থানে আসার শুরুটা আপনার কীভাবে হয়েছিল?

ড. লায়লা খালেদা: ভাল ফলাফল নিয়ে পাস করলেই কিন্তু শিক্ষক হওয়া যায় না। আমার ইচ্ছা ছিল আমি শেষ পর্যন্ত লেগে থাকবো। বিসিএস দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারতাম। তবে, আমি আমার কাজের স্বাধীনতা চাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো অন্য সেক্টরে এতো কাজের স্বাধীনতা নেই। গবেষণা আর পড়ানোর অবারিত সুযোগ এখানে থাকে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এইপথ পাড়ি দিতে কোনো বাঁধার সম্মুখীন কি হয়েছেন?

ড. লায়লা খালেদা: হয়েছি, মাস্টার্স করার পর এমফিল করতে হয়েছে। ঠিক এই সময়টাতেই অর্থনৈতিক একটা সংকটে ভুগেছি। সামাজিক একটা চাপ ছিল, সবাই বলত মেয়ের তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে হচ্ছে না, চাকরি হচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারী দিবস নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

ড. লায়লা খালেদা: আমি আসলে নারী দিবস চাই না, একটা মানুষ দিবস চাই। আলাদা করে নারী দিবসের মূল্যটা আমার কাছে নেই। তবুও যেহেতু নারী দিবস আছে, সেক্ষেত্রে বলবো যে, বর্তমান নারীরা অনেক এগিয়েছে। আমারদের বর্তমান উপাচার্য, তিনিও নারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকটুকু আমাদের এগিয়ে এনেছেন। এখন এটা রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আমাদের৷ আমাদের দেশে শিশু ধর্ষণ, নারী ধর্ষণ এগুলোর বিচার আমি চাই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুব একটা ভালো ফলাফল দেয় না। এই বিচারগুলোর দীর্ঘসূত্রিতা না হয়ে যদি সমাজকে দ্রুত একটা মেসেজ দেওয়া যায় যে, এই কাজের জন্য এই শাস্তি আছে। তাহলে এগুলো কমে আসবে বলে মনে করি। নারীকে তাদের নিজ যোগ্যতায় আরও এগিয়ে যেতে হবে। একথা যেন কেউ না বলতে পারে যে আমি কোটায় ভর করে এসেছি। নারীদের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী চাই, সুন্দর একটা সমাজ চাই, যেখানে সবাই নিরাপদ থাকবে। চাই কাজ করার একটা সুস্থ পরিবেশ।  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীদের এগিয়ে যেতে হলে শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়। এতসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনি অনেক কিছু শিখেছেন। এসব শিক্ষা থেকে কিছু বলুন যা থেকে সমাজের অপরাপর নারীরা এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়।

ড. লায়লা খালেদা: একজন ভালো ছাত্রী তার মেধার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায় তার সংসার হয়, বাচ্চা হয়। ফলে তার কর্মক্ষেত্রে একটা অপারগতার সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টার জন্য পরবর্তীতে নারী শিক্ষক নিয়োগে দ্বিধাবোধের সৃষ্টি হয়। কখনো কোনো ব্যক্তিগত বিষয় কর্মক্ষেত্রে না আনার পরামর্শ থাকবে। কর্মক্ষেত্র আর ব্যক্তিগত বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।

বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে দ্বায়িত্বটা আমার উপরই বর্তায়। আর্থিক একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনেরা চেয়েছিলেন বিয়ে দিয়ে দিতে। তবে আমি আমার লক্ষ্যে স্থির ছিলাম।

আমি ছেলে-মেয়ে কখনও আলাদা করবো না। নারী তুমি এগিয়ে যাও। কখনও ভাববে না সমাজ তোমার দিকে আঙ্গুল তুলছে। সমাজ একদিন বলবে, দুই দিন বলবে, পরের দিন সমাজ তোমার সাথেই থাকবে। কারণ তুমি সমাজেরই একটা অংশ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মূলবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. লায়লা খালেদা: ডেইলি ক্যাম্পাসকেও অংসখ্য ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence