সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য— যেভাবে পরিচালিত হয় এসব প্রতিষ্ঠান
- মো. জাফর আলী
- প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৫ PM , আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২০ PM
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই মূলত উচ্চশিক্ষার ধারা এ অঞ্চলে শুরু হয়, তা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কিছুটা গতি পায়। পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কৃষি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেশ কিছু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর, বিশেষত ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে, যেখানে সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এর ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার লাভ করতে থাকে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)-এর তত্ত্বাবধানে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই পরিচালিত হচ্ছে।
দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামো, প্রশাসন ও অর্থায়নে রয়েছে বৈচিত্র্য। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটি পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে, কোনোটি বেসরকারি উদ্যোগে, আবার কিছু প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরিচালনায় ভোগ করে স্বায়ত্তশাসন। ফলে শিক্ষা-পরিচালনা, শিক্ষক নিয়োগ, টিউশন ফি থেকে শুরু করে গবেষণা কার্যক্রম— সব ক্ষেত্রেই তৈরি হয় মৌলিক পার্থক্য। এ পার্থক্যগুলো আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনা। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এ আয়োজনে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেগুলো হল- সরকারি (পাবলিক), প্রাইভেট (বেসরকারি) ও ইন্টারন্যাশনাল বা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে ইউজিসির তালিকায় ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল (আন্তর্জাতিক) বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩টি। তবে সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি পরিভাষাও রয়েছে। যেগুলোর সংখ্যা দেশে ৪টি। এর বাইরেও রয়েছে প্রযুক্তিভিত্তিক, বিশেষায়িত কিংবা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। যেগুলোর কাঠামো, লক্ষ্য ও পরিচালনা পদ্ধতি একে অপরের থেকে আলাদা।
সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়:
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। তবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ভর্তি প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক, শিক্ষার খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম, এবং সমাজের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর কাছে এটি সবচেয়ে সহজলভ্য উচ্চশিক্ষার পথ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে, যেমন উপাচার্য ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে হয়। তবে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, মেধাভিত্তিক ভর্তি ও গবেষণার সুযোগ এগুলোর বড় শক্তি হলেও, সেশনজট, রাজনীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা প্রায়ই শিক্ষার গতি কমবেশি ব্যাহত করে। এ শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে জগন্নাথ, খুলনা, কুুমিল্লা, বাংলাদেশ কৃষি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সহ মোট ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয়।
এর বাইরে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে আছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, ব্যতিক্রম নামের কারণে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন কেউ কেউ।
গঠন, প্রতিষ্ঠা, ধরন এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার ৬ ভাগে বিভক্ত। সেগুলো হল-
- জেনারেল বা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি);
- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন: বাংলাদেশ কৃষি, গাজীপুর কৃষি, শেরেবাংলা কৃষি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি);
- প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন: বুয়েট, চুয়েট, ডুয়েট, কুয়েট, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি);
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ (যেমন: শাবিপ্রবি, হাবিপ্রবি, মাভাপ্রবি, পবিপ্রবি, নোবিপ্রবি ইত্যাদি);
- মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট মেডিকেল ইত্যাদি);
- বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন: মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, এভিয়েশন এন্ড এ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি)।
তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করেন না। তাদের মতে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটি ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। এর মধ্যে পাবলিক, স্বায়ত্বশাসিত, বিশেষায়িতসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত।
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়:
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনত সরকারি হলেও, পরিচালনায় তুলনামূলক স্বাধীনতা ভোগ করে। অর্থায়নের বড় একটি অংশ আসে সরকারের কাছ থেকেই, কিন্তু অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের স্বাধীন নীতি থাকে। অর্থাৎ- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ/আইন অনুযায়ী পরিচালিত বা পুনর্গঠিত এবং যে-সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট আছে, সেগুলোকেই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান সাধারণত স্থিতিশীল থাকে, কারণ সেশনজট তুলনামূলক কম এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা অধিকতর পেশাদার। তারা নিজস্ব সিন্ডিকেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ করে, যা অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কিছুটা স্বাধীনতা এনে দেয়। কেউ কেউ শুধু এ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে গণ্য করে থাকেন।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এই শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ১৯৭৩ আদেশ অনুযায়ী না চললেও প্রতিষ্ঠান দুটি স্বায়ত্তশাসিত বলে জানা গেছে।
প্রাইভেট বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়:
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এর অনুমোদন ও তত্ত্বাবধান করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), তবে সরকারের আর্থিক সহায়তা থাকে না। এই ধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত উদ্যোক্তা বা ট্রাস্টভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে মূলত পরিচালনা করে একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ ও টিউশন ফি বেশি, ফলে সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয়বহুল।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বড় সুবিধা হল- সেশনজটের অনুপস্থিতি, আধুনিক অবকাঠামো, ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান এবং শ্রমবাজারমুখী শিক্ষা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়মতো ক্লাস, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে কঠোরতা বজায় রাখে, যা শিক্ষার্থীদের দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশে সহায়তা করে। যার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে, বিশেষ করে উচ্চবিত্তদেরকে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে টেনে নিচ্ছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট, গবেষণার সীমাবদ্ধতা ও মান নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
তুলনামূলকভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ, ক্লাস-পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়, এবং পড়াশোনায় প্রযুক্তি ও আধুনিক পাঠদানের ব্যবহার বেশি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আর বহুজাতিক কর্পোরেট জগতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ অনেক শিক্ষার্থীকে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে টেনে নিচ্ছে।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সীমাবদ্ধতা হলো উচ্চ টিউশন ফি। সাধারণ পরিবারের পক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা অনেক সময় সম্ভব হয় না। আবার সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সমান নয়— কিছু প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের হলেও, অনেক জায়গায় শিক্ষকতার মান, গবেষণা সুবিধা কিংবা স্থায়ী ক্যাম্পাসের অভাব এখনো স্পষ্ট। ফলে শিক্ষার মানে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা কাঠামোর জন্য উদ্বেগের কারণ।
দেশে নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল, ইস্ট-ওয়েস্ট, ইনডিপেনন্ডেন্ট, আমেরিকান, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি এবং আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ১১৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল বা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়:
আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এমন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়, যার মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কোনো একক রাষ্ট্রের হাতে নয়; বরং তা পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক সংস্থা, ট্রাস্ট বা আঞ্চলিক অংশীদারিত্বের আওতায়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পরিচালনা কাঠামো আন্তর্জাতিক ধারার হয়, এবং শিক্ষা কার্যক্রম চলে বৈশ্বিক মান ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।
বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে— ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইউটি), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) এবং সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (এসএইউ)।
গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর অধীনে, যেখানে সদস্য দেশগুলোর তহবিল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অংশ নেয় এবং সিদ্ধান্ত হয় আন্তর্জাতিক বোর্ডের মাধ্যমে। চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যা বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠী ও উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয় এবং যেখানে ২০টিরও বেশি দেশের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। অন্যদিকে, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্কের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত, যার প্রশাসন, ভর্তি ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যৌথ অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি:
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১০ এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিধিবদ্ধ হয়। সেই সময়ে ইউজিসির কার্যক্রম ছিল তৎকালীন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা নিরূপণ।
সময়ের সাথে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে ইউজিসির কার্যক্রম বেড়েছে। সেগুলোর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান; উচ্চ স্তরের শিখন-শেখানো পদ্ধতির মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা প্রদান; সর্বোচ্চ উদ্ভাবনী গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা; বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সুশাসন সংক্রান্ত বিষয়সমূহের উন্নয়ন ঘটানো।
এছাড়াও, ইউজিসি উচ্চশিক্ষার নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে মান নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ প্রদান।
ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কার্যক্রম:
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগটি ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নতুন অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিভাগে দুইটি শাখা আছে। সেগুলো হল অ্যাকাডেমিক ও মনিটরিং। এ বিভাগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল- বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অ্যাকাডেমিক কাজে সহায়তা প্রদান এবং উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারকে পরামর্শ প্রদানে কমিশন কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা।
ইউজিসির প্রাইভেট বা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কার্যক্রম:
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয়ের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ করে থাকে। এ বিভাগের প্রধান কার্যাবলি হল- অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয়ে সু-শাসন নিশ্চিত করা; শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করা; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভৌত অবকাঠামো এবং সুযোগ সুবিধাদি পরিদর্শন করা এবং সরকারের নিকট এতৎসংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা; প্রস্তাবিত প্রোগ্রাম সমূহের কারিকুলাম এবং সিলেবাস অনুমোদন দেওয়া; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে আকস্মিক এবং নিয়মিত পরিদর্শন করা; শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সিন্ডিকেট সদস্য মনোনয়ন দেয়া এবং সিন্ডিকেট সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা দেয়া; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, শিক্ষার্থী ভর্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত বিধি বিধান এবং দিক-নির্দেশনা দেয়া; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অভিন্ন গ্রেডিং সিস্টেম তদারকি করা; বিভিন্ন প্রোগ্রাম সমূহের স্ট্যান্ডার্ড কারিকুলাম প্রস্তুতের জন্য দিক-নির্দেশনা দেয়া; শিক্ষার মান নিশ্চিতের জন্য দিক-নির্দেশনা দেয়া; নিয়ম বহির্ভূত র্কাযক্রমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং কমিশনের ওয়েবসাইটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট যাবতীয় র্কাযক্রমের তথ্য হালনাগাদ করা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি:
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ রাষ্ট্রপতির সচিবালয় হিসেবে কাজ করে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রণালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক তদারকি করে, যদিও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক অংশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়াও এই বিভাগ সম্পন্ন করে থাকে। একইভাবে সিনেট, সিন্ডিকেট ও রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের বিশেষজ্ঞ সদস্য মনোনয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রাম ও সংবিধি অনুমোদনসহ নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে মন্ত্রণালয় সরাসরি বা ইউজিসির মাধ্যমে তদন্ত পরিচালনা করে।
অন্যদিকে, ইউজিসি দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা ও সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট অনুমোদন, নতুন পদ সৃষ্টি, বিভাগ ও ইনস্টিটিউট খোলার অনুমতি এবং গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া ইউজিসি “প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক” ও “ইউজিসি স্বর্ণপদক” প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মেধার স্বীকৃতি দেয়। সংবিধি ও অর্গানোগ্রাম প্রণয়নে সহযোগিতা, ই-লাইব্রেরি স্থাপন, সেমিনার ও গবেষণা সহযোগিতা, এবং বিদেশি সম্মেলনে অংশগ্রহণে অর্থসহায়তাও ইউজিসির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. ফজলুর রহমান বলেন, স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলে। মোটাদাগে বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তগুলো নিজেরাই নিতে পারে। সরকার সহজে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বার্গেনিংয়ের একটা স্কোপ আছে। অন্যদিকে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার তার নিজের সিদ্ধান্ত সহজে চাপাতে পারে। আর স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয় বলে আমার ধারণা।