ডায়াবেটিস যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন

যেসব উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবেন
যেসব উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবেন  © প্রতীকী ছবি

ডায়াবেটিস একটি জটিল রোগ। এতে আক্রান্ত হলে রোগীকে সারা জীবন তা বয়ে বেড়াতে হয়। এখন পর্যন্ত এই রোগ নিরাময়ের উপায় আবিষ্কার হয়নি। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি ১১ জনের মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। 

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বর্তমান বিশ্বে যেসব রোগে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে তার মধ্যে ডায়াবেটিস ৪র্থ নাম্বার স্থানে রয়েছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপের উদ্ধৃতি ‍দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন আগামী ২০৪৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: কিডনি রোগ আছে কি-না বোঝার উপায় 

তাই চলুন জটিল রোগ ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তা জেনে নেই:

যেভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবেন

১. নিয়মিত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া: আপনার যদি ডায়াবেটিসে হয়ে থাকে তাহলে আপনি নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিবেন। অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৪ লাখ ডায়াবেটিস রোগী আছেন। এর মধ্যে আবার ৪৬ শতাংশ রোগী তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতেন না। 

অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান জানিয়েছেন, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তারা ডাক্তারের কাছে আসেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ৫-৬ বছর পর। কারণ, তারা জানতেন না এতদিন তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি আরও জানান, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ৫০ ভাগ রোগীই জানেন না তাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে কি না। তবে যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে তারা ডাক্তারের পরামর্শে দ্রুত চিকিৎসা নিবেন।

তাই ডাক্তারের ফলো আপ অ্যাপয়েন্টমেন্টে যোগ দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দেহের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আছে কি-না তা জানতে হবে। নিয়মিত সুগারের মাত্রা যাচাই করতে হবে।

২. ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানা ও তা মেনে চলা: আপনার ডায়াবেটিস হলে কীভাবে জীবন পরিচালনা করবেন তা জানতে হবে এবং মানতে হবে। আর এজন্য একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। যিনি প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য একটা কার্যতালিকা প্রস্তুতে সহায়তা করবেন। এটি প্রস্তুতে যে বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে:

*রক্তে শর্করা কী পরিমাণে আছে
*কি খেতে পারবেন
*ডায়াবেটিস হলে কীভাবে শরীরের যত্ন নেবেন

অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। এদের শনাক্ত করে সঠিক স্বাস্থ্যবিধির উপদেশের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ লোকের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।

৩. সবসময় ডায়াবেটিস সম্পর্কে আপডেট থাকা: রক্তের গ্লুকোজ মিটার, গ্লুকোজ মনিটরিং মেশিন, ইনসুলিন পাম্প, মোবাইল অ্যাপস এবং অন্যান্য প্রযুক্তি সম্পর্কে জানুন যাতে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। কিছু পণ্য যেমন আপনার স্মার্টফোন বা স্মার্ট ঘড়ি দেহের ব্লাড সুগারের মাত্রা ট্র্যাক করে আপনাকে রিডিং মেসেজ পাঠাবে। এতে করে আপনি সবসময় ডায়াবেটিস সম্পর্কে আপডেট থাকতে পারবেন।

আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস আছে কি না যেভাবে বুঝবেন

৪. সুষম খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা: আপনার খাবারের তালিকায় ফল এবং শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করুন। খাবারের পরিকল্পনায় কোন খাদ্যে কার্বোহাইড্রেট কী পরিমাণে আছে জেনে নেবেন। যেসব খাবার আঁশযুক্ত তা বেছে নিতে পারেন।

৫. প্রতিদিন হাঁটা-চলাফেরা করা: হাঁটার অনেক উপকারিতা আছে। প্রতিদিন হাঁটার ফলে পেশী সুগঠিত হয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষিত থাকে ও মেরামত হয়। নিয়মিত হাঁটলে সহজে খাবার হজম হয় এবং মস্তিষ্ক সতেজ থাকে। এর পাশাপাশি হাঁটার ফলে মানুষের চিন্তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, মেজাজ ভালো থাকে এবং মানসিক চাপ কমে। এছাড়া হাঁটা-চলাফেরা করে মানুষের বার্ধক্য বিলম্বিত করা যায়। কিন্তু এসব শারীরিক ব্যায়াম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি প্রতিদিন খাবার খাওয়ার ১০ মিনিট পরে হাঁটা-চলাফেরা করে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। ব্যায়াম ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হাঁটার ফলে শরীরে শক্তি উৎপন্ন হয় আর গ্লুকোজের পরিমাণ কমে ফলে ইনসুলিনের মাত্র নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতিদিন হাঁটলে শর্করা "বার্ন" বা "ক্ষয়" হয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ খান জানিয়েছেন, নগর জীবনে আমাদের শারীরিক পরিশ্রম এবং হাঁটার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। কম্পিউটার বা মোবাইলে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এজন্য প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত একঘণ্টা হাঁটতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন।

ডা. আহসানুল হক আমিন বলেছেন, বর্তমানে পারিবার এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে মা–বাবা ভাবেন তাদের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করা একদম উচিত নয়। সারা দিন শুধু পড়ালেখা করতে হবে। কোচিং করতে হবে, নিয়মিত ক্লাস করতে হবে। মানে এগুলোই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে গেছে। খেলাধুলা ছাড়াই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে তাদের নানা রকম শারীরিক জটিলতা তৈরী হচ্ছে।

আরও পড়ুন: সেহরির যেসব খাবার স্বাস্থ্য ঠিক রাখবে

৬. রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন এবং ব্যবস্থা নিন: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার রক্তে সুগারের মাত্রা নির্ণয় করুন। এবং ব্লাড সুগার লগ রাখুন। যারা টাইপ ১-ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তারা ইনসুলিন ব্যবহার করবেন। যাইহোক, খাবারের আগে এবং পরে পরীক্ষাগুলো করাবেন যাতে আপনি জানতে পারেন কিভাবে বিভিন্ন খাবার রক্তে শর্করার মাত্রাকে প্রভাবিত করে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবেন। রক্তে হঠাৎ শর্করার উচ্চ মাত্রা অনুভব করলে দ্রুত শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করাবেন। রক্তে শর্করার মাত্রা কম হলে শর্করার সেই মাত্রা বাড়াতে ১৫ গ্রাম ওজনের কার্বোহাইড্রেট খেয়ে নিতে পারেন। পনেরো মিনিট পরে রক্তে শর্করার মাত্রা আবার পরীক্ষা করে দেখুন। রক্তে শর্করার পরিমাণ কম বা বেশি যাই হোক যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যাবেন।

৭. মানসিক চাপ মুক্ত থাকা: স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, এমনকি আপনি যখন আপনার খাবারের মেন্যু তৈরী করবেন তখন অবশ্যই খেয়াল করবেন নির্দেশিত ওষুধ গ্রহণ করছেন কি না এবং ব্যায়াম করছেন কি না। যদি প্রয়োজন হয় একজন থেরাপিস্টের সহায়তাও নিতে পারেন।

৮. স্বাস্থ্য সমাস্যাটি কাছের লোকজনদের জানানো: আপনার স্বাস্থ্য সমাস্যাটি কাছের লোকজনদের জানালে বিশেষ করে বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগীতা, সাহস ও সমর্থন পাবেন। তাই আপনার ডায়াবেটিসের বিষয়টি তাদের কাছে কখনো চেপে রাখবেন না। বন্ধুরা এবং পরিবারের সদস্যরা আপনার স্বাস্থ্য সমাস্যাটি শোনার পর স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে সহযোগীতা করতে পারেন।
৯. ভালো থাকুন: সবসময় সুস্থ্য থাকার চেষ্টা করবেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে ওষুধ এবং ইনসুলিন নিতে ভুলবেন না। রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক আছে কি না তা জানার জন্য ঘন ঘন শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করাবেন।


সর্বশেষ সংবাদ