‘যোগ্যতা কাঠামো’য় বাঁধা বিদেশে উচ্চশিক্ষা

ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষায় বাঁধা যেখানে
ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষায় বাঁধা যেখানে  © টিডিসি ফটো

বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন বাতিল হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর যোগ্যতা কাঠামোয়  (কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক) উল্লিখিত শর্ত পূরণের ব্যর্থতায়। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা কিংবা কানাডায় পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে। একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও, তবে কিছুটা কম শর্তের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। সমস্যা সমাধানে দেশীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় করণীয় ধাপগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি হতে হবে সম্পূর্ণ গোঁছানো এবং পরিকল্পিত। তারা বলছেন, শুরু থেকেই কাজ করতে হবে লক্ষ্য স্থির করে এবং কাজ করতে হবে সে লক্ষ্য পূরণে।

সম্প্রতি দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা

আবেদন বাতিল করা বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের আবেদন বাতিলের কারণ হিসেবে জানিয়েছে, শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নের জন্য যে যোগ্যতাগুলো উপস্থাপন করেছে তা কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের (কিউএফ) সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃত নয়। একইসাথে তারা বলছেন, মনোনীত কোর্সগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে না পারায় এসব আবেদন তারা বাতিল করেছে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কাজ করা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন যোগ্যতা কাঠামো অনুসরণ করে থাকে। সেক্ষেত্রে দেশগুলোর শর্তও থাকে আলাদা। তবে দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু সহজ শর্ত বা বিষয় থাকে তা পূর্ণ করতে পারলে তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষায় যেতে পারে। এক্ষেত্রে দেখতে হবে বিষয় এবং কোর্সভিত্তিক সামঞ্জস্যতা। 

আরও পড়ুন: টাইমস হায়ার র‌্যাঙ্কিং: শীর্ষ ৬০০-তে নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়

তারা বলছেন, অস্ট্রেলিয়া সাধারণত তিনটি বিভাগে ভাগ করে তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করে থাকে; প্রথম সেকশনে তারা পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেকশনে তারা প্রথম সারির এবং মানসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৃতীয় ধাপে রাখা হয় সাধারণত মানে পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এ তালিকায় পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকলেও রয়েছে বেশিরভাগ মানহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা‘র (ইউনেস্কো) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। বিগত সালে ১১ হাজার ১৫৭ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন আবুধাবি ও দুবাইসহ ইউএইর উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোয়। সে হিসেবে গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া মোট শিক্ষার্থীর ২২ শতাংশই গেছেন ইউএইতে। 

সাম্প্রতিককালে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা

ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ২০২২ সালে দেশের বাইরে গিয়েছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্যের তালিকায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; গত বছর ৮ হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার ১৮০ জন শিক্ষার্থী যান।

আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলোতে সবচেয়ে ভালো করছে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা

পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, বিগত সালে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্যের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষার্থী গেছেন ৫ হাজার ৬৭৪ জন। আর পঞ্চম অবস্থানের দেশ কানাডায় গেছেন ৬ হাজার ১৩৬ জন। এছাড়া শীর্ষ ১০ গন্তব্যের বাকি দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪, জাপানে ২ হাজার ৮০২, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন।

আর শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভালো অবস্থান নিশ্চিতে কাজ করতে হবে দেশীয় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিশেষ করে দেশের উচ্চশিক্ষা যেন বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মানের হয় তা নিশ্চিত করতে হবে শুরু থেকেই। এক্ষেত্রে দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকেই নিশ্চিত করতে হবে পরিকল্পনা, আর সামগ্রিক বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের।

সাম্প্রতিককালে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা

অস্ট্রেলিয়ান কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কে (একিউএফ) বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে হলে আগ্রহী বিষয় বা ডিগ্রির সাথে সামঞ্জস্য থাকতে হবে পূর্ববর্তী ডিগ্রির (গবেষণা, কোর্সওয়ার্ক বা বর্ধিত)। তবে, শিরোনামের সাথে ব্যতিক্রম থাকলেও শর্ত পূর্ণ করতে পারলে শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। একইসাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসাবে স্বীকৃত প্রতিটি যোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নথিভুক্ত পথ অন্তর্ভুক্ত থাকার পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির যোগ্যতা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে (আবেদনকারীর দেশীয় যোগ্যতা কাঠামো) অবশ্যই একিউএফ যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণ করতে হবে। পাশাপাশি থাকবে অন্যান্য চলমান শর্ত এবং যোগ্যতা নীতি। এছাড়াও প্রায় একই রকম থাকছে অন্যান্য দেশের যোগ্যতা কাঠামোগুলোও।

আরও পড়ুন: টাইমস হায়ার এডুকেশনে বিশ্বের সেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে সম্প্রতি যাত্রা শুরু করা ‘বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো’য় (বিএনকিউএফ) জানানো হয়েছে, দেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কাঠামো বজায় রেখে জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতার উন্নয়ন, শ্রেণিবিন্যাস ও স্বীকৃতিকে সর্বসম্মতভাবে কয়েকটি আপেক্ষিক স্তরে সমন্বয় করা হবে এ কাঠামোয়। নতুন এ কাঠামোর ফলে দেশে ১০টি স্তরে উচ্চশিক্ষা, সাধারণ, কারিগরি, মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যকর সমন্বয় ও আন্তঃসংযোগের ব্যবস্থা রাখা হবে শিক্ষার্থীদের জন্য। যাতে শিক্ষার্থীরা দেশে এবং বিদেশে সমান যোগ্যতার মানদণ্ডে অবস্থান করতে পারে।

আকর্ষণীয় ক্যাম্পাস আগ্রহের শীর্ষে থাকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

‘যোগ্যতা কাঠামো’র শর্তে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আবেদন বাতিলের বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলে বিইএসআই স্টাডি কনসালটেন্সির সিনিয়র অ্যাডমিশন অফিসার (আন্তর্জাতিক) মো. ইকবাল হোসেন এবং পিএফইসি গ্লোবালের অস্ট্রেলিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা শাকিলা কামালের সাথে। তারা বলছেন, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা তিন ভাগে ভাগ করে আবেদন গ্রহণ করে থাকে। যা তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের ফ্রেমওয়ার্ক বা যোগ্যতা কাঠামো অনুযায়ী হয়ে থাকে। মূলত সে কাঠামো অনুযায়ী, তারা শিক্ষার্থীদের আবেদন গ্রহণ বা বাতিল করে। 

‘আমরা কোনো শিক্ষার্থীর আবেদন করার সময় তার ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো দেখে আবেদন সম্পন্ন করে থাকি; ফ্রেমওয়ার্ক বিবেচনা করে করেই আমরা বিষয়গুলো বুঝতে পারি। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা জানে না যে তাদের সার্টিফিকেটগুলো সেখানে পড়ার উপযোগী বা যোগ্য কি-না। সেজন্যই তাদের আবেদন বাতিল হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার পরামর্শ, আবেদনের আগে বিস্তারিত তথ্য এবং প্রক্রিয়া জেনে আবেদন করার। আর কোর্স সংক্রান্ত শর্ত না পূরণ করলেও ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাসে’ (এসওপি) যদি শিক্ষার্থীরা দক্ষতার সাথে তাদের বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারে তাহলে আবেদন বাতিলের সুযোগ থাকবে না’—যুক্ত করেন শাকিলা কামাল ও মো. ইকবাল হোসেন।

আরও পড়ুন: এশিয়ার শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আধিপত্য চীনের

এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান মনে করেন বিভিন্ন দেশের যোগ্যতা কাঠামোর বাধা দূর করে দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতে কাজ করতে দেশীয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ নিয়ে আমাদের দেশে এখন কিছু কাজ শুরু হয়েছে; তবে, আমাদের আরও কাজ করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়ছে। ইউজিসি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও তা আমলে নিয়ে কাজ করছে। তবে, কোন প্রতিষ্ঠান যদি তা পূর্ণ করতে না পারে বা না করে তবে তার দায় তদারক সংস্থাগুলোর।

সঠিক পরিকল্পানা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এনে দিবে উচ্চশিক্ষায় সাফল্য

ড. এস এম হাফিজুর রহমান হাফিজুর মনে করেন, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের এখানে খুব বেশি কিছু করার না থাকলেও কাজ করতে হবে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের। কেননা, কোন ভুল নীতি বা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তার ভুক্তভোগী হবেন শিক্ষার্থীরা। দেশের বাইরের ভালো এবং নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ তৈরির পাশাপাশি তাদের দক্ষতা সৃষ্টির পর উদ্যোগী করতে হবে দেশের জন্য কাজ করতে।

অন্যদিকে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের ইতোপূর্বেই নির্দেশনা দিয়েছি আন্তর্জাতিক কারিকুলামের সাথে সমন্বয় করে সিলেবাস তৈরি করার জন্য। এ বিষয়গুলো আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের পরামর্শ থাকবে, তারা যেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর ভর্তি নিশ্চিত করেন।


সর্বশেষ সংবাদ