বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ইতিহাস

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠদানের চিত্র
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠদানের চিত্র  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার ইতিহাস একটি দীর্ঘ এবং বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এর শিকড় ঔপনিবেশিক যুগে প্রোথিত এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এটি বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সময়ের সাথে সাথে এর প্রসার ঘটেছে এবং এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ইতিহাসের একটা চিত্র তুলে ধরা হল:

ঔপনিবেশিক যুগ (ব্রিটিশ শাসনকাল): ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তন

বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার সূচনা হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয়ভাবে ইংরেজি শিক্ষিত একটি শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা এদেশে ইংরেজি ভাষার স্কুল ও কলেজ স্থাপন শুরু করে।

প্রাথমিক পর্যায়: ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, খ্রিস্টান মিশনারিরা এ অঞ্চলে প্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্মপ্রচার করা, তবে এর পাশাপাশি তারা স্থানীয়দের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার আলোও ছড়িয়ে দেন। ক্যালকাটা ব্যাপটিস্ট মিশন এবং অন্যান্য মিশনারি সংস্থা বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই স্কুলগুলোতে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোলের মতো বিষয়ও পড়ানো হতো।

সরকারি উদ্যোগ: ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সরকারও ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল ও কলেজ স্থাপন শুরু করে। ১৮৩৫ সালের মেকলে মিনিট ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নীতির ফলস্বরূপ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ঔপনিবেশিক যুগে প্রতিষ্ঠিত কিছু উল্লেখযোগ্য ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলো স্থানীয় এলিট শ্রেণির সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। এই সময়ের শিক্ষা মূলত সরকারি চাকরি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করত। সাধারণ মানুষের জন্য এই শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন সহজলভ্য ছিল না।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি: ঔপনিবেশিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর শিক্ষাক্রম মূলত ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে তৈরি করা হতো। ইংরেজি সাহিত্য, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত এবং বিজ্ঞান ছিল প্রধান বিষয়। পরীক্ষা পদ্ধতিও ব্রিটিশ ধাঁচের ছিল। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না।

 

পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১): সীমিত প্রসার

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের অংশ হয়। এই সময়ে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার প্রসার কিছুটা ধীরগতি লাভ করে।

সরকারি নীতি: পাকিস্তান সরকার উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়, যার ফলে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তবে, সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তান এবং সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা অব্যাহত থাকে।

বেসরকারি উদ্যোগ: এই সময়ে কিছু বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশি সংস্থা এবং মিশনারিগুলো তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এবং নতুন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এই স্কুলগুলো মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এদের শিক্ষাব্যয়ের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল।

বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত কিছু উল্লেখযোগ্য ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজ (যেখানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হতো), হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং অন্যান্য খ্যাতনামা মিশনারি স্কুলগুলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উচ্চমানের শিক্ষার জন্য পরিচিত ছিল।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি: এই সময়ের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো মূলত ক্যামব্রিজ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষার প্রস্তুতি এই স্কুলগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকত। পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 

স্বাধীন বাংলাদেশ (১৯৭১-বর্তমান): দ্রুত বিস্তার ও বহুমুখিতা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ধারার শিক্ষা দ্রুত প্রসার লাভ করতে শুরু করে।

প্রাথমিক পর্যায় (১৯৭০-১৯৯০): স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা খুব দ্রুত না বাড়লেও, শহরাঞ্চলে এর চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলেন অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন, তাদের সন্তানদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল একটি পছন্দের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতো।

মধ্যবর্তী পর্যায় (১৯৯০-২০০০): নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষাখাতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এই সময় অনেক নতুন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে। অভিভাবকদের মধ্যে তাদের সন্তানদের একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই স্কুলগুলোর চাহিদা বাড়তে থাকে।

বর্তমান পর্যায় (২০০০-বর্তমান): বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে একাধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বিদ্যমান। এই স্কুলগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে, যার মধ্যে ক্যামব্রিজ এবং এডেক্সেল প্রধান।

বিভিন্ন ধরনের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল: বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল দেখা যায়। কিছু স্কুল সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে, যেখানে কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাই শিক্ষার মাধ্যম থাকে। আবার কিছু স্কুল জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও, কিছু বিশেষায়িত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে, যেমন আন্তর্জাতিক স্কুল এবং বিদেশি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুল।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি:

বর্তমানে বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে প্রধানত দুটি আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে, যা তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক কর্মজীবনে প্রবেশে সহায়ক।

১. ক্যামব্রিজ অ্যাসেসমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন: এই শিক্ষাক্রমের অধীনে প্রাইমারি, লোয়ার সেকেন্ডারি, আইজিসিএসই এবং এ-লেভেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ক্যামব্রিজ তাদের শিক্ষাক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী একটি মান বজায় রাখে।

২. এডেক্সেল: এটিও একটি ব্রিটিশ শিক্ষাক্রম এবং বাংলাদেশে এর অধীনে আইজিসিএসই এবং ইন্টারন্যাশনাল এ-লেভেল পরীক্ষা নেওয়া হয়।


সর্বশেষ সংবাদ