আইনের কারণে ‘মওলানা’ হয়ে গেল ‘মাওলানা’
নামের ভুলেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম
- নূর এ আলম নুহাশ
- প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০৭:৫৫ PM , আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০৫:০৬ PM
আইন পাসের সময় লেখা ভুল বানানেই চলছে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) সকল কার্যক্রম। দেশের বই-পুস্তকসহ বিভিন্ন স্থাপনায় এই নেতার নামের শুরুতে ‘মওলানা’ লেখা হলেও তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা হয়েছে ‘মাওলানা’ শব্দটি। নামের এই ভুল বানান নিয়ে নিয়মিত বিব্রত হতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।এরপর ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০১’ (৩৭ নং আইন) পাশ হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশের ১২তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু আইন পাশের সময় ‘মওলানা’ শব্দের পরিবর্তে তখন ‘মাওলানা’ শব্দটি লেখা হয়। ফলে এক প্রকার আইন মেনেই ভুল নাম বয়ে বেড়াচ্ছে দেশের অন্যতম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন গণআন্দোলনের তৃণমূল নেতা ছিলেন কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও রেখেছিলেন সক্রিয় ভূমিকা। মজলুম জননেতা ভাসানী চাইতেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে তাঁর অবদানকে স্মরণ করেই ১৯৯৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকার।
টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছে। বর্তমানে ৬টি অনুষদের অধীনে ১৮টি বিভাগে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থীর অধ্যয়ন করছে। তাদের বিপরীতে শিক্ষক রযেছেন ২৩৯ জন। শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন প্রায়োগিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে দক্ষ ও আলোকিত মানবসম্পদে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরেও নামের বানানের এই ভুল সংশোধন না হওয়ায় প্রায়শই বিব্রত হতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বলেন, আমাকে তো সব অফিসিয়াল কাগজে প্রতিষ্ঠানের নাম লিখতে হয় ‘মাওলানা ভাসানী’, কিন্তু বাইরের সবাই তো ‘মওলানা’ নামেই অভ্যস্ত। এজন্য মাঝেমাঝে সার্টিফিকেট অনুসারে আমি ঠিক লিখলেও অন্যরা ভাবে আমি ভুল লিখছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বেলাল হোসেন বলেন, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুরা এই নামের ভুল নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে। তখন খারাপ লাগে। নামের এই ভুল সংশোধন করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন কিংবদন্তী নেতার নামের বানানে ভুল থাকাটা ‘বেমানান’ বলে জানালেন মওলানা ভাসানীর একান্ত সহচর এবং মাভাবিপ্রবির ভাসানী স্টাডিজ বিভাগের কোর্স শিক্ষক সৈয়দ ইরফানুল বারী।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর জীবদ্দশায় সবসময় তিনি তাঁর নাম মওলানা লিখেছেন। তাঁর মৃত্যুর আগে ও পরের সকল বই-পুস্তক ও পত্রিকাতেও তাঁর নামের ক্ষেত্রে মওলানা ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ‘মাওলানা’ শব্দটি থাকায় সেটিকেই লিখতে হচ্ছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কারোর আইনের বাইরে যাবার সুযোগ নেই।
তবে নামের বানানে পরিবর্তন হলেও এটাকে ভুল বলছেন না সৈয়দ ইরফানুল বারী। তিনি বলেন, এতে নামের ভিন্ন অর্থ কিংবা ভিন্ন ব্যক্তিকে বুঝায় না। এক ব্যক্তিকেই বুঝায়। তবে সরকার কেন ‘মওলানা’ এর পরিবর্তে ‘মাওলানা’ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি পাস করেছিল তা বলতে পারবো না। এই বিষয়ে সরকার ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানানে এখন পরিবর্তন আনা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিষয়। যদিও আইন সংশোধন করে এই বিষয়টি ঠিক করা অনেক জটিল প্রক্রিয়া, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উদ্যোগ নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করলে হয়তো সেটা সম্ভব হতো। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো উপাচার্য নিজ উদ্যোগে এই বিষয় নিয়ে অগ্রসর হননি।
তবে নামের এই ভুল এতদিনেও সংশোধন না হওয়ার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করা উপাচার্যদের মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও গুরুত্বহীনতাকে দায়ী করেন তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানতে উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. এ আর এম সোলাইমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম নামের ভুলের জন্য তাদের কিছু করার নেই বলে জানান। তিনি বলেন, আইনের কারণে আমাদের মাওলানা শব্দটিই লিখতে হচ্ছে। আর আইন সংশোধনের এখতিয়ার তো আমাদের হাতে নেই, মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাতে। একই সঙ্গে নাম সংশোধনের প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল। তবে সবাই যদি দাবি তোলে তাহলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে দাবিটি পেশ করবো।