‘নতুন জুতাটা এক সপ্তাহও পরতে পারেনি ছেলেটা’

আবরার ফাহাদ ও তার মায়ের কান্না
আবরার ফাহাদ ও তার মায়ের কান্না  © ফাইল ফটো

সকাল ১০টা, মঙ্গলবার।  শরতের এই সকালে কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। যার চিহ্ন তখনও বহন করে চলেছে ভেজা মাটি ও গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা। কুষ্টিয়ার পিটিআই রোডে অবস্থিত বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের বাসায় ঢোকার আগের দৃশ্য ছিল এটি। মেধাবী এই ছাত্র হত্যার এক বছরের মাথায় সকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত কুষ্টিয়ার গণমাধ্যম কর্মীরা। কিন্তু তখনও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি ভেতরে কি চলছে। গাছের পাতা ও মাটিতে থাকার বৃষ্টিচিহ্ন হয়তো কিছু সময় পর শুকিয়ে যাবে। কিন্তু আবরারের মায়ের চোখের জল যে কখনো শুকানোর নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেল মমতাময়ী মা রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই। চোখ বেয়ে তখনও বৃষ্টির পানির মতো গড়িয়ে যাচ্ছে নোনা জল...। এক বছরের মাথায় এখনও তিনি ছেলেকে খুঁজে ফিরছেন।

পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার এক পর্যায়ে তিনি একটাই দাবি করে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। তারপরও ওকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে’। ‘এখন আমার একটাই দাবি আবরারের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হোক এবং তা দ্রুত কার্যকর হোক। ওর বৃদ্ধ দাদা যেন তা দেখে যেতে পারেন।’

আবরারের জামা-কাপড়, বইপত্র, ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখিয়ে রোকেয়া খাতুন বলেন, নতুন জুতাটা এক সপ্তাহও পরতে পারেনি ছেলেটা। জুতার দিকে তাকিয়ে থাকার এক পর্যায়ে চোখে পানির বাঁধ তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়। আবরারের মায়ের এমন ব্যাকুলতা দেখে সেখানে উপস্থিত অনেকেই নীরবে চোখের পানি ফেলেন।

কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামিয়ে আবরারের মা বলেন, যাকে কোনোদিন আমরা একটা চড়ও মারিনি। সবাই দেখেছে আমার সেই আবরারকে কত নির্মমভাবে মারা হয়েছে। এখন একটাই দাবি সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড চাই। আর এই মৃত্যুদন্ড যেন তাড়াতাড়ি কার্যকর হয়, যাতে আবরারের বৃদ্ধ দাদা তা দেখে যেতে পারেন। ওর দাদা ওকে কোলে-পিঠে করে অনেক কষ্টে মানুষ করেছিলেন। তার এখন ৯০-এর উপরে বয়স। আমাকে প্রশ্ন করে, তোমার ছেলের হত্যার বিচার কবে হবে? আমি দেখে যেতে পারব না? এই কথার কোনো উত্তর দিতে পারি না। সবতো আমার হাতে নেই। মামলার সাক্ষ্য শুরু হয়েছে। ওর আবরারের বাবা সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এত ভালো একটা ছেলে, ওকে এত নির্মমভাবে মরতে হবে কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। মা হিসেবে অনেক সময় রাগ হয়, মনে মনে বলি ওদেরকে হাতের কাছে পেলে পেটাব, কিন্তু দেশে তো আইন আছে, এ কথা আমি বলতে পারি না, দেশের আইন অনুসারেই চলছি।

তিনি বলেন, ‘ওই সময় দেশের সব ইউনিভার্সিটির ছেলেরা যেভাবে বিচার দাবিতে তোলপাড় করেছে আমি দেশের ওইসব শিক্ষার্থীর জীবনের নিরাপত্তা চাই। শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশের সব শিক্ষার্থী যেন তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারে। কোনো মা যেন এই চিন্তা না করে যে আমার সন্তান ফিরে আসবে তো?’

আবরারের বাসায় উপস্থিত প্রতিবেশী রহমত আলী বলেন, মেধাবী একটা ছাত্র কি যে কষ্ট দিয়ে মারল, শুনলে চোখের পানি আটকায় না। আমরা এর সব হত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড চাই।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান আতা বলেন, আবরারের পরিবার যেন সঠিক বিচার পায় আমি সেই দাবি করব। প্রধানমন্ত্রী তো কাউকেই ছাড় দেন না। ওইসব দুষ্কৃতকারী যারা সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে এতবড় কান্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সবারই যেন সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়।

আবরারের ছোট ভাই ফাইয়াজ আবরারও এখন শহরের এই বাড়িতেই থাকেন। ভাইয়ের রুমের পাশেই তার রুম। মাঝে ভাইয়ের রুমের শূন্য বিছানা গুছিয়ে দেন তিনি, ভাইয়ের এটা সেটা নেড়ে আবার যত্নে সাজিয়ে রাখেন।

ফাইয়াজ আবরার বলেন, করোনার কারণে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল বিচার কাজ। আবার শুরু হয়েছে। এখন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তিনজন আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি, তাদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি করেন ফাইয়াজ আবরার।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর শেরে বাংলা হলের ২০০৫ নম্বর কক্ষে একদল বিপথগামী ছাত্র ৬ ঘণ্টা ধরে নির্মম নির্যাতন করে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করে। পরদিন ৭ অক্টোবর সকালে তার লাশ উদ্ধার হলে প্রতিবাদে সারাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনার পর ভূমিকার জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, মিডিয়া, প্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আবরারের মা বলেন, রায় ও তা কার্যকর পর্যন্ত সবাই যেন তার পাশে থাকেন।


সর্বশেষ সংবাদ