‘মা–বাবার সঙ্গে ঈদের স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুরা বাড়ি ফিরে, আর আমার তো মা–বাবাই নেই’

রাকিন
রাকিন  © টিডিসি

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিন পাটওয়ারি। শৈশবে বাবা–মাকে হারিয়ে দারিদ্র্য আর শোকের সঙ্গেই বড় হয়েছেন তিনি। জীবনের প্রতিটি বাঁকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও হেরে যাননি কখনো। 

রাকিনের জন্ম নারায়ণগঞ্জ শহরে, এক সাধারণ পরিবারে। বাবা লুতফর রহমান পাটওয়ারি ছিলেন কাপড় ব্যবসায়ী এবং মা খাদিজা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাকিন সবচেয়ে ছোট। শৈশব থেকেই পারিবারিক অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তবু পড়াশোনায় বরাবরই মনোযোগী ছিলেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াতে তা মা বাবা অনেক খুশি হয়।

কিন্তু সময় রাকিনের জীবনে স্থায়ী করে রাখেনি কোনো আনন্দ। জেএসসি পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে, হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান তার বাবা। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মা। এরপর একাধিক স্ট্রোকের কারণে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই কঠিন সময়ে পরিবারের সব কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ছোট্ট রাকিন। রান্না, ঘর পরিষ্কার, বাজার—সবকিছু একা সামলাতে হতো তাকে।

পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও মায়ের প্রতি ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই চলছিল জীবনের সংগ্রাম। কিন্তু নিয়তির নির্মম আঘাত থেমে থাকেনি। চিকিৎসার জন্য বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরও তিন মাসের মাথায় মারা যান তার মা। একে একে দুই অভিভাবককে হারিয়ে রাকিনের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ শূন্যতা।

মায়ের মৃত্যুর পর সংসারের ভার যেন পুরোপুরি তার কাঁধেই চেপে বসে। বড় দুই ভাই কাজে গেলে রাকিন একা হাতে সামলাতেন পুরো ঘর। এমন অবস্থায়ও তিনি পড়াশোনা ছাড়েননি। বরং একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নপূরণের পথে।

২০১৮ সালে আইইটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং ২০২০ সালে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৮৩ অর্জন করেন তিনি। তবে আর্থিক সংকটের কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে পারেননি। চাচাতো বোনের পুরোনো বইগুলোই ছিল তার একমাত্র সহায়। সেসব বই পড়ে তিনি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মাভাবিপ্রবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।

আরও পড়ুন: যে ঈদ শেখায়—লোভ আর অহংকার বিসর্জনেও আছে আনন্দ

বর্তমানে রাকিন টিউশনি করে নিজের খরচ চালান। যেকোনো প্রয়োজনে কাছে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠী ও কিছু সিনিয়র বড় ভাইদের। ছোট থেকেই রান্না তার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তার সহপাঠীদের মতে, রাকিন শুধু একজন সংগ্রামী শিক্ষার্থীই নন, বরং চমৎকার রান্নাও করতে পারেন।

রাকিন পাটওয়ারি বলেন, “এসএসসিতে ভালো ফলের পেছনে আমার মায়ের দোয়াই সবচেয়ে বড় অবদান। তখন সারাদিন ঘরের কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। করোনার সময় পড়াশোনার জন্য কোনো স্মার্টফোন ছিল না। তিন ভাই মিলে খাবারের সংস্থান করতেই হিমশিম খেতাম। মোবাইল ফোন তখন আমার কাছে বিলাসিতা ছিল।”

তিনি আরও বলেন, “আমার দুই ভাই এবং আমার চাচিই আমার জীবনের বড় শক্তি। চাচির দেওয়া খাতা-কলম, বই আর ভালোবাসাই আমাকে সাহস দিয়েছে। আমার স্বপ্ন, একদিন একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলবো—যেখানে কোনো বাবা–মা একাকীত্বে থাকবেন না, অবহেলায় মর্যাদা হারাবেন না। আমি চাই, তাদের সময় দিতে, তাদের সেবা করতে। মা–বাবাকে হারিয়ে আমি বুঝেছি, তাদের গুরুত্ব কতটা গভীর। তাই অন্যদের মা–বাবার মুখেও হাসি ফোটাতে চাই।”

রাকিন বলেন, "মা–বাবার সঙ্গে ইদের স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুরা বাড়ি ফিরছে, আর আমি? আমার তো মা–বাবাই নেই। ইদের আগে হলে মনে হয়, সবাই যেন কারও না কারও কাছে ফিরছে, আর আমি শুধু ফাঁকা ঘরেই ফিরি। মা-বাবার স্মৃতিগুলোই তখন আমার একমাত্র সঙ্গী।”

ইদের দিনে যখন বন্ধুরা বাবা–মায়ের কাছে ছুটছে, তখন রাকিন ফিরে যান স্মৃতির কাছে। তবু তিনি বিশ্বাস করেন—আল্লাহ একদিন তার সব কষ্টের বিনিময়ে তাকে পুরস্কৃত করবেন। কারণ, সংগ্রামই তার প্রেরণা, আর স্বপ্নই তার শক্তি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence