পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রতিষ্ঠাতা’ আওয়ামী লীগ নেতা
- শিহাব উদ্দিন ও বেলাল হোসাইন
- প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৪ PM , আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১১:১৪ AM
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকার। এর আইন পাস হয় জাতীয় সংসদে কণ্ঠ ভোটের মাধ্যমে। ক্যাম্পাস নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ থেকে শুরু করে— ভিসি নিয়োগ সবই হয় সরকারের নির্দেশে। সে হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সরকার নিজেই। তবে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে দেশের ৪০তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে (তৎকালীন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ক্ষেত্রে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম রয়েছে জামালপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কোনো ব্যক্তি হতে পারে না বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
সংস্থা দু’টির কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়। এর প্রকৃত মালিক জনগণ। ফলে কোনো ব্যক্তির প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার সুযোগ নেই।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মির্জা আজমের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় পাস হয়েছিল। সিন্ডিকেট সদস্যরা মনে করেছিলেন, যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মির্জা আজমের চেষ্টার কারণে অনুমোদন হয়েছে; সেহেতু তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। আওয়ামী লীগের আমলে সমগ্র জামালপুর মির্জা আজমের ভয়ে তটস্থ থাকত। আমি ভিসি হলেও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। মেয়াদ শেষের দিকে হওয়ায় চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছ ‘—অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ, সাবেক উপাচার্য, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কোনো ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন বা কোনো নীতিমালাতেই এমন কিছুর উল্লেখ নেই। কাজেই কোনো ব্যক্তিকে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা করা হয়, তাহলে সেটি নিয়মবহির্ভূত।’
জানা গেছে, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে স্থাপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি জামালপুর জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে মালঞ্চ বাজারের উপকণ্ঠে অবস্থিত। তৎকালীন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নীতি পাশ হয়। একই বছরের ২০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৭’ সর্বসম্মতিক্রমে ও কণ্ঠভোটে পাস হয়। ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি গেজেটভুক্ত হয়।
‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কোথাও কোনো ব্যক্তি এর প্রতিষ্ঠাতা হতে পারেন না। যদি এমন কিছু ঘটে থাকে তাহলে সেটি নিয়মবহির্ভূত ভাবে করা হয়েছে’—এ এস এম কাসেম, সিনিয়র সহকারী সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর শেখ পরিবারের নামে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম পরিবর্তনের দাবি উঠলে এটির নাম পরিবর্তন করে ‘জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১তম সিন্ডিকেট সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর আগেও একবার সিন্ডিকেটে এ প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তৎকালীন কোষাধ্যক্ষের বিরোধীতায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল মাননান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রথমে যখন এ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, তখন আমি বিরোধীতা করে বলেছিলাম, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হয় না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নেই। তখন মির্জা আজম বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমি এত কিছু করলাম’। প্রতিউত্তরে বলেছিলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে করেন। পরে একটি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মির্জা আজমের নাম অনুমোদন করা হয়। তখন কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। কারণ প্রতিবাদ করে লাভ হত না।’
২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মির্জা আজমের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় পাস হয়েছিল। সিন্ডিকেট সদস্যরা মনে করেছিলেন, যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মির্জা আজমের চেষ্টার কারণে অনুমোদন হয়েছে; সেহেতু তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কোনো ব্যক্তি হতে পারে না। তবুও কেন তাকে প্রতিষ্ঠাতা করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘সমগ্র জামালপুর মির্জা আজমের ভয়ে তটস্থ থাকত। আমি ভিসি হলেও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। মেয়াদ শেষের দিকে হওয়ায় চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছে।’
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এ এস এম কাসেম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কোথাও কোনো ব্যক্তি এর প্রতিষ্ঠাতা হতে পারেন না। যদি এমন কিছু ঘটে থাকে তাহলে সেটি নিয়মবহির্ভূত ভাবে করা হয়েছে।’
৫ আগস্টের পর থেকে মির্জা আজম পলাতক থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।