টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে বুয়েট ছাত্রদের গ্রেফতার নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক

আটকের পর শিক্ষার্থীদের জেলা আদালতে তোলা হয়
আটকের পর শিক্ষার্থীদের জেলা আদালতে তোলা হয়  © সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া শিক্ষার্থীদের জামিন দিয়েছে সুনামগঞ্জের একটি আদালত। সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল গত রবিবার। গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে ২৪ জন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী, ৭জন সাবেক শিক্ষার্থী এবং তিনজন তাদের স্বজন। গ্রেফতার দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের জামিন আবেদন শিশু আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করে আসামিপক্ষের আইনজীবী তৈয়বুর রহমান বাবুল জানিয়েছেন, এই শিক্ষার্থীরা হাওরে ঘুরতে এসেছিলেন। পুলিশ শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করেছে।

তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতার যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, পুলিশ সেগুলো প্রমাণ করতে পারেনি। তাদের কাছ থেকে মামলার অভিযোগ প্রমাণের মতো কোন তথ্য উপাত্ত উদ্ধার হয়নি বলেও জানান তিনি।

মি. বাবুল বলেন, ‘তারা কিছু ইসলামী বই আর স্ক্রিনশট পেয়েছে। এগুলো অনেক মুসলমান ছেলের কাছেই থাকতে পারে। এই শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের কেউই কোন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নেই। এই কথাগুলো আমরা আদালতকে জানিয়েছি। সার্বিক তথ্য প্রমাণ বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন।’

এদিকে মামলার তদন্তের স্বার্থে বিশেষ করে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানতে শেষ মুহূর্তে আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিল পুলিশ। তবে আদালত রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে তা খারিজ করে দেন।

রবিবার বিকেলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের পাটলাই নদী দিয়ে ট্যাকেরঘাট পর্যটন এলাকায় যাওয়ার পথে পুলিশ তাদেরকে আটক করে।

পুলিশের অভিযোগ, তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পেরেছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক হিসেবে আসা ৩৪ জনের একটি দল ‘সরকার বিরোধী নাশকতার’ পরিকল্পনা করছিল।

পুলিশ দাবি করছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সবাই ‘ইসলামী ছাত্রশিবিরের দ্বারা অনুপ্রাণিত’। শিক্ষার্থীদের আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতার দেখানো হয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘন:
শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন গুরুতর অভিযোগ আনা এবং কয়েকদিন ধরে তাদের নাজেহাল করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

মি. খান প্রশ্ন তোলেন, ছাত্ররা যদি কোন দলের হয়ে শলা-পরামর্শ বা অ্যাকশনের পরিকল্পনা করেই থাকে, সেজন্য কী টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে হবে? ঢাকা বা বুয়েটের ভেতরে কোন জায়গা নেই?

হাওরে এমন কিছু নেই যা ধ্বংস করার জন্য তাদেরকে এতদূর যেতে হবে। তাই এই ঘটনা পুলিশ যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, সেটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন—যুক্ত করেন তিনি।

সম্প্রতি সরকার জামায়াতে ইসলামীকে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিয়েছে। সে হিসেবে জামায়াত কিংবা অন্যান্য সংগঠন যদি দূরে কোথাও গিয়ে বৈঠক করেও থাকে, তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার কথা না বলে মনে করেন মি. খান।

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে নাশকতার পরিকল্পনা করার বা জামায়াত শিবিরে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে এর পক্ষে পুলিশ নিশ্চিত কোন কারণ দেখাতে পারেনি। তাই পুলিশের অভিযোগ মিথ্যাও হতে পারে বলে তিনি জানান।

মি. খান বলেন, ‘বুয়েটের এতোজন শিক্ষার্থী সবাই একই সংগঠনের হওয়ার সুযোগ আমি দেখি না। এছাড়া নাশকতার পরিকল্পনা বা নাশকতায় অংশ নিতে যে আলামত দরকার সেগুলো পুলিশের জব্দ করে দেখানো উচিত ছিল।’

বাংলাদেশে প্রায়শই পুলিশ অনেককে গ্রেফতার করে জামায়াত, শিবির, জঙ্গি এই পরিচয় যুক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করে। এই শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মি. খান। তার মতে, পুলিশ যেসব আলামতের কথা বলেছে সেগুলো খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না।

‘বাংলাদেশে যখন কাউকে জঙ্গি বা শিবির নামে গ্রেফতার করা হয়, তখন জঙ্গি, শিবির, ইসলামের নামে হাতে গোনা কয়েকটি বই হাজির করা হয়। বইগুলো আসে কোথা থেকে, আদৌ তাদের থেকে উদ্ধার হয়েছে কিনা—সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।’

‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়, পরে তারা মুক্তি পান যথারীতি। এই শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কি হয়েছে তা এখনই বলার সুযোগ নেই।’ এই বিষয়গুলোর বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হওয়া দরকার বলেও তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখা উচিত, শিক্ষার্থীদের যে অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা আদৌ এ ধরণের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত কি না। গ্রেফতারের পেছনে অন্য কোন কারণ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।

‘এটি যদি সাজানো ঘটনা হয়, তাহলে যারা হয়রানি করেছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হলেও তা করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে কাউকে হয়রানি করার ক্ষেত্রে তারা সতর্ক থাকেন’—যুক্ত করেন তিনি।

পুলিশের ভাষ্য:
শিক্ষার্থীদের আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরদিন সোমবার বিকেলে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে পুলিশ বাদী হয়ে তাহিরপুর থানায় একটি মামলা করে।

এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বিকেলে তাদের আদালতে হাজির করলে আদালতের বিচারক ৩২ জনকে কারাগারে এবং দুজন কিশোর হওয়ায় তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এ সময় নৌকার দুই মাঝিকে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তাহিরপুর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাশেদুল কবির বাদী হয়ে আটককৃত ৩৪ জনের মধ্যে বুয়েটে অধ্যয়নরত ২৪ জন, সাবেক বুয়েট শিক্ষার্থী ৭ জন এবং অন্যান্য ৩ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাহিরপুর থানায় রুজু করা হয়।

শিক্ষার্থীদের আটকের বিষয়ে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবু সাঈদ। এই বিজ্ঞপ্তির একটি অংশে জানানো হয়েছে, শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, জানমালের ক্ষতি সাধন, রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার লক্ষ্যে বুয়েট শাখার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বায়তুলমাল বিষয়ক সম্পাদক আফিফ আনোয়ার এর নেতৃত্বে এই শিক্ষার্থীরা হাওড়ে একত্রিত হয়েছিলেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে তাদের তল্লাশি করে তাদের হেফাজতে থাকা ৩৩টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন, ছাত্র শিবিরের বিভিন্ন কার্যক্রম সংক্রান্ত স্ক্রিনশটের কপি, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কল্যাণ তহবিল সংক্রান্ত প্রচারপত্র, সদস্য, সাথীদের পাঠযোগ্য কোরান ও হাদিসের সিলেবাস, কর্মী ঘোষণা অনুষ্ঠান সংক্রান্ত স্ক্রিনশটের কাগজপত্র জব্দ করা হয়।

এদিকে গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের কেউ কোনও ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত নয় বলে শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল তাদের অভিভাবকরা। মঙ্গলবার বুয়েটের শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ দাবি করেন আটককৃত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা।

আটক এক শিক্ষার্থীর বাবা আব্দুল কাউয়ুম জানিয়েছেন, তার সন্তান যে ঘুরতে গিয়ে আটক হবেন, তিনি সেটা ভাবতেও পারেননি।

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে ২২ বছর ধরে আমি বড় করেছি। সে কোন ধরণের রাজনীতির সাথে জড়িত না। রাষ্ট্রীয় কোনও ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তারা হাওড়ে ঘুরতে গিয়েছিল। এরপর তাদেরকে কেন গ্রেফতার করলো আমরা কিছুই জানি না।’

‘এই শিক্ষার্থীদের আদালতে তোলার আগ পর্যন্ত জানতো না যে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই কয়দিন আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি’—জানান এই অভিভাবক।

কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আহ্বানও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ